এপার বাংলাদেশের অলিনগর আমলিঘাট ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম। শক্তিশালী পাম্প মেশিন বসিয়ে (গোল বৃত্ত) ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন করছে ভারত। এ রকম ২৬টি পাম্প রয়েছে ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে পানি উত্তোলনের জন্য
৬ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৪:২৮

ফেনী নদীর পানি নিয়ে যাচ্ছে ভারত ৩৫ হাজার হেক্টর জমির আবাদ ব্যাহত

চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে বয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ বাংলাদেশেই উৎপত্তি হওয়া ফেনী নদীতে ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় করে বাঁধ দিয়েছে বাংলাদেশ। আর কোনো চুক্তি ছাড়া, কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এ ফেনী নদী থেকে ভারত নিয়ে যাচেছ পানি। অবিরাম পানি নিয়ে যাওয়ার ফলে এখন শুষ্ক মওসুমে পানি শুকিয়ে নদীর তলাই দেখা যাচ্ছে। মিরসরাই, ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজীর অর্ধশত খাল ছরাও গেছে শুকিয়ে। সন্নিহিত এলাকার চাষিরা কেউ সেচ দিতে পারছেন না। পাউবো ও বিজিবির দফায় দফায় আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের পরও হচ্ছে না কোনো ফল। ফেনী নদী থেকে বয়ে আসা মিরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট, ২নং হিঙ্গুলী ৩ নং জোরারগঞ্জ, ৪ নং ধূম ও ৫ নং ওচমানপুর ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি খাল ছরা এখন শুকিয়ে সেচ তো দূরের কথা পরিবেশ রক্ষাও হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। একইভাবে ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলারও অন্তত ১০টি ইউনিয়নে ফসলের মাঠ পানিশূন্য হয়ে আছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ৩ উপজেলায় প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। অপরদিকে ভারত দিব্যি এর চেয়ে অনেক বেশি জমিতে সেচ দিয়ে উৎপাদন করছে ফসল।

মিরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন জানান, আমার এলাকার নতুন ও পুরাতন লক্ষীছরা খালটি শুকিয়ে পানিশূন্য। অন্তত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালসহ হিঙ্গুলী খাল, তেলিয়া খাল ও অন্যান্য ছরাগুলো সব শুকিয়ে গেছে। সেচের কোন উপায় নেই। এলাকার হাজার হাজার কৃষক পারছে না চাষাবাদ করতে। নদীর তীরে যারা আছে তারাই পাম্প দিয়ে শুধু পানি দিচ্ছে। ভারতের বিপক্ষে কোনো মন্তব্য না করে এ সমস্যার সমাধান চান তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বলেন, আমার উপজেলার অন্তত ৫০টি খাল ছরাই আজ পানি শূন্য। হাজার হাজার কৃষক পানি থেকে বঞ্চিত। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজন বিষয়টির আশু সমাধান করা। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বোরো চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে চাই সহজভাবে সেচের পানি দিয়ে। কিন্তু ভারতের পানি চুরির জন্য তা ব্যাহত হওয়ায় আমরা আগামীদিন নিয়ে শংকিত।’

সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের নিজস্ব নদী ফেনীর পানি ভাগাভাগির জন্য ভারত সরকার পানি চুক্তি করার চাপ দিচ্ছে। পাউবোর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী খ. ম জুলফিকার তারেক বলেন, ‘কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়া ভারত অন্যায়ভাবে এত বছর ফেনী নদী থেকে পাম্প বসিয়ে পানি নিয়ে গেছে। এখন তারা চুক্তি করতে চায়। অবৈধভাবে পানি তুলে নেয়ার প্রতিবাদে এবারও চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি সমাধান হতে ঢাকা-দিল্লী বৈঠক ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত ৩৫ বছরের গঙ্গা চুক্তির ২০ বছরেও প্রয়োজনীয় পানি দেয়নি ভারত। দু’দেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ভাগবাটোয়ারা এখনো মীমাংসা হয়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের বাহানায় দীর্ঘদিন থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তিস্তা চুক্তি। আর এখন বাংলাদেশের ফেনী নদীর পানি গোপনে তুলে নিচ্ছে, আবার এ নিয়ে মাথা ঘামানোর পর শুধুমাত্র এই নদীর পানি নিতে চুক্তি করতে চায়। এতেই প্রতীয়মান চুরিকৃত পানির প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব অনেক বেশি। আমাদের নদী, আমাদের বাঁধ, আমাদের পানি।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চলের মহুকুমা সাব্রুমের ১৭টি পয়েন্টে ২৬টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসিয়ে ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। নদীর পাড়ে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে বসানো ২৬ পাম্প দিয়ে ভারত পানি তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিবাদ প্রতিরোধে কর্ণপাতই করছে না ভারত।

এতে মিরসরাই উপজেলার বিস্তির্ণ এলাকা ও ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার কিছু জনপদ মরুভূমিতেও পরিণত হচ্ছে। সেচ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার কৃষক। ফেনী নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে মুহুরী প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য ফেনী নদীতে পানি সঞ্চয় করে রাখছিল বাংলাদেশ।

জানা যায়, বাংলাদেশের উক্ত ফেনী নদীতে শুষ্ক মওসুমে সর্বোচ্চ ২৫০ কিউসেক পানি থাকে। তা থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সরকার গোপনে নোম্যান্সল্যান্ড মাটির নিচে নদী তীরে পাম্প বসিয়ে একশ’ কিউসেক পানি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পানি নেয়ার জন্য তারা নদীর তীরে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে ২৬টি পাম্প বসিয়েছে। এসব পাম্প মেশিনে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি সিআই পাইপ লাগানো হয়েছে। এসব মেশিন দিয়ে গোপনে নদী থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে; যা আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নীতির চরম লঙ্ঘন। এর আগে ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশের তরফ থেকে পানি উত্তোলনের বিষয়ে বিরোধিতা করা হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে গোপনে আবার পানি উত্তোলন শুরু করে তারা। মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর গ্রামের ওপারে আমলিঘাটেও রয়েছে একটি শক্তিশালী সেচ পাম্প, যা দিয়ে দিন রাত উত্তোলন হচ্ছে পানি।

কয়েকমাস পূর্বে ও রামগড় সীমান্তের ওপারে সাব্রুমে অনুষ্ঠিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) যৌথ বৈঠকে নতুন করে ফেনী নদীর পানি তুলে নেয়ার ইস্যুটি সামনে আসে। এই বৈঠকে নোম্যান্সল্যান্ড ভারতের অবৈধভাবে বসানো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ চালিত পাম্প মেশিন তুলে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিএসএফকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বিজিবি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত ভারত কোনো জবাব দেয়নি।

এই বিষয়ে বিজিবি রামগড় জোন ইনচার্জ লে. কর্নেল এম. জাহিদুল রশীদ বলেন, ‘ভারত ফেনী নদী থেকে ২৬টি পাম্প মেশিনের মাধ্যমে দৈনিক এক শতাধিক কিউসেক পানি নিচ্ছে। এখন বাংলাদেশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে আরও ১৮২ কিউসেক পানি নিতে চায়। সাব্রশুম মহকুমার বাসিন্দাদের পানির চাহিদা মেটাতে তারা ফেনী নদীর পানি নেয়ার এ দাবি করছে।’

ভরা বর্ষা ছাড়া বছরের বাকি ১০ মাস পানি উত্তোলন হয়। একতরফাভাবে পানি তুলে নেয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে ফেনী নদী শুকিয়ে ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়।

এদিকে মৃতপ্রায় এ নদী থেকে ভারত চুক্তির মাধ্যমে আরো ১৮২ কিউসেক পানি তুলে নেয়ার জোর তদবীর চালাচ্ছে বলেও জানা যায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাম্প মেশিনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভারতের পানি উত্তোলন বন্ধ করার পর ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি করতে কোনো আপত্তি নেই।

এই বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা পানি সম্পদ ফোরামের সভাপতি প্রফেসর ডা. জামশেদ আলম জানান, ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ। এ নদীর পানি ভারতকে দেয়ার জন্য চুক্তি কিসের? ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে দুই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ফেনী নদীর নাম নেই বলে জানা যায়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেনী নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার ভগবানটিলায়। নদীর ১০৮ কিলোমিটারের কোনো অংশই ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি। ১৯৬৫ সালে প্রস্তাবিত এবং আশির দশকে স্থাপিত মুহুরী সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি প্রধান ফেনীর ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে শুল্ক মৌসুমে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বছর বছর বোরো আবাদ কমার ধারায় চলতি মওসুমে বোরো আবাদ অর্ধেকের চেয়ে বেশি কমে গেছে বলে জানা গেছে। সার, ওষুধ, তেল, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বোরো আবাদ করে লোকসান গুনছেন মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকরা। করেরহাট অলিনগর গ্রামের কৃষক গোলাম সোবহান জানান, খরচের চেয়ে ধানের দাম কম হওয়ায় লোকসানের ভয়ে ইরি-বোরো লাগাতে তারা আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে পানি সেচ সহজ হলে সকলে আবার চাষাবাদে আগ্রহী হবে।

মিরসরাই উপজেলা কৃষি সুপারভাইজার নুরুল আলম বলেন, মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় ইরি-বোরো আবাদ কমে যাওয়ায় কৃষি প্রধান এই অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন আশঙ্কাজনকহারে কমছে, পানি রক্ষার সমস্যা সমাধান না হলে কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্য নিয়ে মুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্ব হারাবে। তিনি বলেন, উপজেলায় পানির ওপর নির্ভর ছিল। সেচ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে থাকলে এর লক্ষ্যমাত্রা আরা ১ হাজার হেক্টর বেশি থাকতো। এ অঞ্চলের কৃষকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখছে অন্তত সরকার এই পানি চুরির সংকট সমাধান করবে শীঘ্রই আর কৃষকরাও আগের মতো চাষাবাদে সুফল পাবে।

http://www.dailysangram.com/post/274419