৬ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৩:৫৪

দেখা অদেখা

বিতর্ক আর বিভাজনের রাজনীতি

সালাহউদ্দিন বাবর

বাংলাদেশে বিতর্ক ও বিভাজনের রাজনীতির অভিজ্ঞতা নতুন নয়। সব সময়েই বিতর্ক-বিভক্তি ছিল, এখনো আছে। যৌক্তিক কারণে এবং কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য গঠনমূলক বিতর্ক অবশ্যই কল্যাণকর। কিন্তু বিতর্কের জন্য বিতর্ক ও বিরোধিতার জন্য অহেতুক বিতর্কের অবতারণা সূত্রে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে বিভাজন সৃষ্টি হলে, সেটা মোটেই কল্যাণকর কিছু বয়ে আনে না। সম্প্রতি দেশে বিতর্ক ও বিভাজন ক্রমাগত বাড়ছে। আর তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যেকোনো অকারণ বিতর্ক দেশের সামগ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমরা যে বিতর্কের কথা বলছি, তা অযৌক্তিক নয়। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা অবশ্য ভিন্ন একটি আশঙ্কার কথা ভাবছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের এসব বিতর্ক আবার আগামী নির্বাচনে না গিয়ে পড়ে। তাই বিতর্কিত সব বিষয় একটা সীমার মধ্যে থাকুক, তারা এ আশা করেন।

দেশের বিরাজমান গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে এখন কথা হচ্ছে। বিরোধী পক্ষ বলছে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, ক্ষমতাসীনেরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করছে না। ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি যথা সভা-সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি অবাধে পালন করছে, কিন্তু বিরোধী দলকে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালনে অনুমতি দিচ্ছে না। বিরোধী দলকে বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে না দিয়ে তাদের জনসংযোগ করার অধিকার বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারের ভুলনীতি এবং জনস্বার্থের পরিপন্থী কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদন এসবেরই প্রমাণবহ। ২০১৬ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর সম্প্রতি এর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সভা সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করেছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা বিচারবহির্ভূত হত্যা। এ ছাড়া এ প্রতিবেদনে এ-ও উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বিতর্কিত। নির্বাচনগুলোতে সরকার অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছে।

নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণ। এই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনকে ত্রুটিমুক্ত করার দাবি নিয়ে চলছে নানা কথা। বস্তুত নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অতীতে বেশির ভাগ সময় নির্বাচন নিয়ে জনগণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব সরকার গঠিত হয়েছে, তারা কখনো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে পারেনি বিরোধিতার মুখে। নির্বাচন ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় তাদের প্রতিপক্ষ আন্দোলনে নেমেছে। অনেক সময় দেখা যায়, নির্বাচনে কোনো বিরোধী পক্ষ থাকে না। নির্বাচন বর্জন করে। এতে যে সরকার ও সংসদ গঠিত হয়, তা আর গ্রহণযোগ্যতা পায় না।

এখন যে সংসদ রয়েছে তা এমনই এক সংসদ। এই সংসদ কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। শুধু সরকার সমর্থকেরা সংসদে থাকায় ক্ষমতাসীনদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কেমন হবে, সে বিষয় নিয়ে এখন কথা হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু এই ধরন ও মানের নির্বাচন হচ্ছে না সম্প্রতি। এ নিয়ে সব সময় বিতর্ক লেগেই আছে। কখনো কখনো ভালো মানের নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এমনটি বলা যায় না। একটি জাতীয় নির্বাচনে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বহু মানুষ নিহত হয়। টাকার খেলা চলে, ভোট কেনাবেচা হয় বেশুমার। ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীরা নির্বাচনে নানা কলকাঠি নাড়ে। পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যাতে শান্তিপূর্ণ হয় এবং জনগণ যাতে উপলব্ধি করে তার ভোটের শক্তি আছে। তখনই গণতন্ত্র সার্থকতা পায়। রাজনীতিতে বিতর্ক আছে, থাকবে। কিন্তু একটি বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী দলকে বিতর্ক পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তারা জাতিকে সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দেবেন।

প্রতিটি শিশু জন্ম নেয় কিছু মৌলিক অধিকার নিয়ে। এটা সব দেশে এবং আন্তর্জাতিক বলয়ে স্বীকৃত। বাংলাদেশসহ বহু দেশে এই অধিকার কাগজ-কলমে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। মানুষের এই অধিকার খর্ব হয় ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, প্রভাবশালী মহল ও অপশক্তির হাতে। বাংলাদেশের বিরাজমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক বলয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। দেশের সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সন্নিবেশিত রয়েছে। কিন্তু যারা এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবেন, তাদের ভূমিকা ইতিবাচক নয়। সম্প্রতি কতগুলো বিষয় লক্ষণীয়, বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের হঠাৎ করে গুম করা হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীই নয়, সাধারণ মানুষও গুম হচ্ছে। ক’দিন পর গুম হওয়া মানুষের মৃতদেহ ডোবানালায় পাওয়া যাচ্ছে। আবার কারো কারো খোঁজখবর কখনোই পাওয়া যায় না। নারী নির্যাতন এবং তাদের হত্যা-ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটছে। রাজনৈতিক কর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি গাইবান্ধার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে : কিভাবে সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সরকারি দলের সংসদ সদস্যকে খুন করেছেন সরকারের সহযোগী অপর এক দলের নেতা।

খুন হওয়ার পর সরকার ও সংবাদমাধ্যমগুলো কোনো অপেক্ষা না করেই এ জন্য দোষারোপ করতে শুরু করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর। তাদের বহু লোককে আটক করা হয়। এখন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে সত্য ঘটনা। অথচ নিরপরাধ লোকদের কারাগারে ঢোকানো হলো এবং সংবাদপত্রগুলো তাদের চরিত্র হনন করল। তার প্রতিবিধান কে করবে?

বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংবিধানে সংরক্ষিত রয়েছে। তথাপি এই অধিকারের ওপর স্বাধীনতার পর থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। একপর্যায়ে পত্রপত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত জারি করা হয়। শুধু সরকারই নয়, নানা প্রভাবশালী মহল থেকেও বিভিন্ন সময় নানা চাপ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের ব্যাপারে কলম চালালে তারাও সংবাদকর্মীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। সম্প্রতি যথার্থ কারণেই সম্পাদক পরিষদ থেকে সংবাদপত্রে সরকারের আচরণের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। এমনকি জাতীয়তাবাদ নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য। আমাদের পরিচয় হবে বাঙালি হিসেবে নয়, বাংলাদেশী হিসেবে। এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দল এবং সাধারণের মধ্যে বিতর্ক ও বিভক্তি রয়েছে। এ ছাড়া অনেক মৌলিক বিষয়ে দেশে বিতর্ক বিরাজ করছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি মৌলিক বিষয়। জনগণের অধিকার বলবৎ করার ক্ষেত্রে এবং জনগণ উৎপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্বাহী বিভাগের সাথে বিতর্ক চলছে। সরকার তথা নির্বাহী বিভাগে যখনই যারা থাকেন, তারা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেন। বিশেষ করে নি¤œ আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য বিচার বিভাগের প্রয়াস এখন লক্ষ করা যাচ্ছে। এই মর্মে একটি মামলার রায়ও হয়েছে উচ্চ আদালতে, যা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ গড়িমসি করছে। আদালত তা বাস্তবায়নের জন্য বারবার তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাহী বিভাগ নি¤œ আদালত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। আরেকটি বিষয় নিয়ে বিচার বিভাগের সাথে আইন বিভাগের মন কষাকষি চলছে; সেটা হচ্ছে উচ্চ আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের দাবি সব সময়ই ছিল। কেবল আইনানুগ ব্যবহার পাওয়ার যে অধিকার জনগণের রয়েছে, তা এখন দেশে কায়েম নেই। জনগণ সর্বত্র আইনানুগ ব্যবহার পাচ্ছে না। সম্প্রতি দেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আইনের শাসন কায়েমের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি রয়েছে। আর তা ছাড়া আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণ। সেই জনগণ রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়ভিত্তিক আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে। সম্প্রতি একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, উচ্চ আদালত বিনা বিচারে আটক বেশ কিছু মানুষ জামিন দিয়েছেন। এই মানুষেরা বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক ছিল। আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়নি বলে তাদের দীর্ঘকাল কারা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আইনের শাসন কায়েম থাকলে এমন অত্যাচার একজন মানুষের প্রতি হতে পারে না। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে দিনের পর দিন জেলে অন্তরীণ থাকেন।

হালে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের পর। ইসি গঠন যে প্রক্রিয়ায় এবং যে সময় নিয়ে করা হয়েছে, তা সব মহলের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। এই পর্যায় পর্যন্ত কোনো বিতর্ক ও বিভাজন লক্ষ করা যায়নি, কিন্তু ইসি গঠনের পর যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) নামসহ অন্য কমিশনারদের নাম প্রকাশ করা হয়, তখন এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং বিভাজনও দেখা যায়। বিতর্ক তৈরি হয় মূলত সিইসিকে নিয়ে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তার (সিইসি) সাথে ক্ষমতাসীনদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাকে যে প্রক্রিয়ায় বাছাই করা হয়েছে, তা নিয়েও পত্রপত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তা ছাড়া সিইসি তার নিজ এলাকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কাছে পুষ্পস্তবক গ্রহণসহ মিষ্টি খেয়েছেন। এ নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সিইসির পক্ষে কথা বলা হয়েছে। ইসি গঠনের আগে সব তরফ থেকে এর নিরপেক্ষতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থাকেনি। এই মুহূর্তে এ নিয়ে বিতর্ক আর অগ্রসর না হলেও এ ক্ষেত্রে ক্ষত অবশ্যই কিছু হয়েছে, যা ভবিষ্যতে বড় হতে পারে।

আর যে বিষয়টি নিয়ে এখন কথা হচ্ছে, তা হলোÑ নির্বাচন সময়ের সহায়ক সরকার। এ বিষয়টি তুলেছে বিএনপি। নির্বাচনের সময় দলীয় সরকারের পরিবর্তে একটি নির্বাচনসহায়ক সরকার ক্ষমতায় থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। এ সরকারের স্বরূপ, প্রকৃতি ও করণীয় সম্পর্কে বিএনপি এখন কিছু বলেনি। তবে এই সরকারের একটি রূপরেখা বিএনপি দেবে বলে জানা গেছে। বিএনপি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কথা বলেছে। বিএনপি এখন নির্বাচনসহায়ক সরকারের বিষয়টি জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার চালাচ্ছে। এই ইস্যুতে বিএনপি আন্দোলন করবে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপি এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলেছে। বিএনপির এই মতের বিপক্ষে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা সর্বত্র বলছেন, আগামী নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। আওয়ামী লীগ অবশ্য নির্বাচনকালীন সরকারেরও একটি রূপরেখা দিয়েছে। তাতে এটা রয়েছে যে, নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বিভিন্ন দলের লোক নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। তারাই নির্বাচন পরিচালনা করবেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময়ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বিএনপি সে সময় ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট নেয়ার প্রস্তাব করেন। বিএনপিসহ আরো অনেক দল এই ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরাও ইভিএমের বিপক্ষে। তাদের বক্তব্য হলো, ইভিএম একটি উচ্চতর প্রযুক্তি। দেশের কোটি কোটি ভোটারের এ সম্পর্কে সাধারণ কোনো জ্ঞান পর্যন্ত নেই। তাদের পক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহারে ভোট দেয়া সম্ভব হবে না। এ সম্পর্কে যাদের মেশিন চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের সহায়তা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দু’টি ব্যাপার ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, ভোটের গোপনীয়তা বিনষ্ট হবে এবং ভোটদানে যিনি সহায়তা দেবেন তিনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে ভোট অন্যত্র চলে যেতে পারে। তা ছাড়া দেশের দুর্গম এলাকাসহ হাজারও নির্বাচনী কেন্দ্রে এই প্রযুক্তি নিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন কেন্দ্রের মেশিনে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়। তা ঠিক করার ব্যবস্থা কী হবে। যদি না করা যায়, তাতে গোটা ভোটব্যবস্থা ভণ্ডুল হতে পারে।

উন্নয়ন নিয়ে বহু কথা রয়েছে। আগামী নির্বাচনে এটাকে ক্ষমতাসীনেরা বড় ইস্যু করবে। নির্বাচনী প্রচারে উন্নয়নকে ব্যাপক আকারে তুলে ধরা হবে। উন্নয়নের বিষয় নিয়ে আলোচনা বেশ আগে থেকে শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে সম্প্রতি বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, তাদের নির্বাচিত করা হলেই দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে কিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব ছাড়া তেমন উন্নতি হয়নি। দেশে নতুন কোনো কর্মসংস্থান নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা চলছে। বিনিয়োগের কোনো লক্ষণ নেই। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি, দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল। এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। বিদ্যুতের দাম বাড়বে, এমন ঘোষণা এসেছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন স্থানে পড়বে। দেশে পরিবহন ব্যয় বাড়বে। আর তা সাধারণ মানুষের ওপর গিয়ে পড়বে। বিনিয়োগ নেই; ফলে নতুন কর্মসংস্থান হবে না। বেকারত্ব কমবে না। শিল্পপতি ও অর্থনীতিবিদেরা বর্তমান উন্নয়ন সম্পর্কিত বক্তব্যের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নয়। সম্মুখে নতুন বাজেট আসছে। প্রতিটি বাজেটের ধাক্কা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। নতুন কর আরোপ হয় এবং জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। উন্নয়ন বলতে এটা বোঝায় না যে, গুটিকয় লোকের উন্নয়ন। তারা ভালো থাকছেন, বিদেশে টাকা জমাচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা করাচ্ছেন। এতে দেশে ধনিক শ্রেণীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন এটা নয়। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন হলে তাকে বলা যাবে উন্নয়ন।

সরকারের উন্নয়ন বলতে কোনো একটি ক্ষেত্রের উন্নয়নকে বোঝায় না। যেমন বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে চরম নৈরাজ্য। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নানা সমস্যা রয়েছে। সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আর এই ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নৈরাজ্য। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশে স্কুল-কলেজ হচ্ছে অহরহ, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কী মানে এবং কিভাবে চলছে, সে দিকে সরকারের দৃষ্টি নেই। স্কুলের ছাত্রদের বিনামূল্যে বই সরবরাহ একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এসব বই বিতরণের ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম রয়েছে। যথাসময়ে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া এসব পাঠ্যপুস্তকের ছাপার মান অত্যন্ত নি¤œমানের। বইয়ের পাঠ্যসূচি নিয়ে সম্প্রতি সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। মানুষের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী বিভিন্ন বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক-বিক্ষোভ সৃষ্টি হলে, পরে তা সংশোধন করা হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/201151