৫ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১২:৪৮

সরকার সভা সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করেছে

২০১৬ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হচ্ছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আর এর পেছনে সরকারের মদদ রয়েছে বলে ইঙ্গিত করেছে দেশটি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা সমাবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করে দিয়েছে। 

গত শুক্রবার প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, অসাম্প্রদায়িক, বহু মতের সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর বেসামরিক প্রশাসনের ‘কার্যকর নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে। এরপর জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনার পরপরই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-। এছাড়া অবৈধভাবে আটক, সরকারি বাহিনীর হাতে গুম, জঙ্গিদের মাধ্যমে হত্যাকা-, বাল্য বিয়ে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, শ্রমিকদের জন্য অনিরাপদ কর্মপরিবেশের বিষয়টিও উদ্বেগজনক বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ঘটছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের যে নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার এখন ক্ষমতায়, সেই নির্বাচনকে অধিকাংশ আন্তজাতিক পর্যবেক্ষক বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিক মানদন্ডের স্বল্পতা রয়েছে বলে সমালোচনা করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, উগ্রবাদী সংগঠন দায়েশ (আইএস) ও আলকায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশীয় সংস্করণ একিউআইএস এর তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক, মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য গ্রুপের মানুষদের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার শক্তিশালী জঙ্গিবাদ-বিরোধী অভিযান চালানোর ফলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, অবৈধভাবে আটক এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সীমিত করার ক্ষেত্রে সরকার জঙ্গিবাদ-বিরোধী অভিযানের বিষয়টি ব্যবহার করছে বলেও প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার সমস্যা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, অবৈধ আটক, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংযোগে গুম, জঙ্গি মতবাদে উদ্বুদ্ধ গ্রুপের হত্যাকা-, বাল্য বিয়ে, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং শ্রমিক নির্যাতন।

কয়েকজন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের বরাত দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, সাংবাদিকরা নিরাপত্তা বাহিনীর ভয়ে নিজেদের মধ্যে সেলফ-সেন্সরশিপ আরোপ করছেন। যদিও সরকারের সমালোচনা করাটা খুবই সাধারণ ঘটনা, কিন্তু কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারিভাবে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের দুর্বলতা এবং বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে আটকের বিষয়টিও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া অনলাইনে মত প্রকাশ এবং এনজিওগুলার কাজে নিয়ন্ত্রণ আরোপকেও দেখানো হয়েছে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে।

প্রতিবেদনে আমারদেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, টিভি ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না, সাংবাদিক কনক সরোয়ারসহ সাংবাদিকদের হয়রানির কথা উল্লেখ করা হয়।

নির্যাতনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীকে দায় মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ সীমিত। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আস্থাহীনতার কারণে জনগণ অনেক সময়েই তাদের শরণাপন্ন হয় না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে ‘ভিকটিমদের’ দায়ী করে সরকারের বক্তব্যের সমালোচনাও করা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে নিরাপত্তা বাহিনীকে দায়মুক্ত করছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ক্রমাগত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এসব হামলাকারী গ্রুপ যেমন বিদেশী জঙ্গি সংগঠনে প্রভাবিত, তেমনি এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণও জড়িত।

হামলাকারীরা নিজেদের আইএস বা আল-কায়েদার সহযোগী বলে দাবি করে থাকে। এদের হামলায় আটজন হিন্দু, দু’জন খ্রিস্টান, দু’জন বৌদ্ধ, একজন সুফি এবং একজন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়েছেন। আরও চারজন হিন্দু ও দু’জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী গুরুতর আহত হয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন করতে প্রতিটি নাগরিককে সংবিধান অধিকার দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে সরকার অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছে এবং সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা সমাবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করে দিয়েছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে। ফলে অর্ধেকেরও বেশী আসন বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় ও বাকীগুলোতে স্বল্প প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ পায় ২৩৫টি আসন। বয়কট করার কারণে বিএনপি কোন আসন পায়নি। ৩৬টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়, ক্ষমতানীস দলের জোটের শরীক জাতীয় পার্টি। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এই নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন বলে চিহ্নিত করেছে। পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী চার্জ গঠনের জন্য সরকার তার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর হয়রানির কারণে জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা চালাতে পারছে না।

সরকারি দল ও তাদের সহযোগী দলগুলো সহিংসতায় জড়িত, প্রকাশ্য তারা তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্য তৎপরতা সীমিত করে দেয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে তারা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করেছে।

ওই প্রতিবেদনের ভূমিকায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেছেন, মানবাধিকার রক্ষা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলাই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, ‘একটি দৃঢ়, নিরাপদ এবং কার্যকরী সমাজ গড়ে তোলার ভিত্তিই হলো এই বিষয়গুলো। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র শুধু নৈতিক উপদেশ নয়, বরং এটি বিশ্বকে আরও দৃঢ় ও নিরাপদ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়।

http://www.dailysangram.com/post/274303