৫ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১২:৩৮

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

সরকার নিজেই কি অস্থিতিশীলতা ডেকে আনছে?

স্বাধীনতার পর থেকেই লক্ষ্য করছি সরকার সবসময় সবচেয়ে সহজ কাজটিই করে। যেসব কাজে কোনো মেধা লাগে না, পরিশ্রম লাগে না সেসব কাজ সরকার অবলীলাক্রমে করে। সর্বশেষ যেমন করেছে গ্যাসের ক্ষেত্রে। সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে দুই দফায়। প্রথম বাড়বে ১ মার্চ থেকে। দ্বিতীয় দফায় বাড়বে ১ জুন থেকে। হিসাব ঠিকই আছে। জুন মাসে নতুন বাজেট আসছে। তখন আরেক দফা নানা দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির আশংকা আছে, তাই গ্যাসের দামটা অগ্রিমই বাড়িয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই বাড়ানোর কাজটি সহজ, তাই সরকার হরেদরে এটা করে। কর বসানো, উৎসে কর কাটা, ভ্যাট বসানো, বিনা বিচারে সম্পদ করারোপ ইত্যাদি দায়িত্ব সরকার সুচারুরূপে পালন করে। এসব করার সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একবারও ভাবে না শিল্পের ওপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কী পড়বে, কী প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ওপর। যদি ভাবত তাহলে মাত্র চার হাজার দু’শ কোটি টাকার মতো বাড়তি টাকা তুলতে গিয়ে গ্যাসের মূল্য ২৩ শতাংশ বাড়াত না। ২৩ শতাংশ হচ্ছে গড়ের হিসাব। বাসাবাড়ির ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির হার ৪৬ থেকে ৬০ শতাংশ। চিন্তাভাবনা করে দাম বাড়ালে মূল্যবৃদ্ধির হার এত বেশি হতো না। ভাবা যায় ৬০০ টাকার স্থলে ৯০০ টাকা, ৬৫০ টাকার স্থলে ৯৫০ টাকা যথাক্রমে এক বার্নার ও দুই বার্নারের মাসিক চার্জ!

কী হবে জানি না, আপাতত এ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদিকে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা জোরালোভাবে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, তারা রফতানির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বেন। এমনিতেই এ শিল্পে ‘কম্পায়েন্সের’ কারণে বহু বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে। রয়েছে নানা অনিশ্চয়তা। এর ওপর বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। যা সামলে উঠে ব্যবসা করা কঠিন। আবার আসছে ভ্যাটের ধকল। ‘ব্রেক্সিট’ নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। ট্রাম্প সাহেব শেষ পর্যন্ত কী করেন তাও জানা যাচ্ছে না। এর মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু দাম বাড়ানোর পর কি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া যাবে? প্রতিষ্ঠিত শিল্পে গ্যাস সরবরাহ অনিয়মিত। প্রতিষ্ঠিতব্য শিল্পে সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। সংযোগের ভরসা নেই বলে শিল্পঋণ মঞ্জুর হচ্ছে না। এত অনিশ্চয়তার পর ‘এলপিজি’ যদি আসে, যা মন্ত্রী বাহাদুর চান, তাহলে কি খরচে পোষাবে শিল্পপতিদের? প্রাইভেট গাড়িওয়ালাদের? মধ্যবিত্ত কি ‘এলপিজি’র বোঝা টানতে সক্ষম হবে? অথচ এমন একটা অনিশ্চিত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সরকারই স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কারণ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতেই তরুণ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাহেব ক্ষান্ত হচ্ছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়াবেন। গ্যাস ও বিদ্যুৎ- এ দুইয়ের মূল্যবৃদ্ধি পরিষ্কারভাবে অর্থনীতিতে এক নতুন অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করবে। বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম এখনও স্বাভাবিক এবং নিম্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক বস্তুত কোনো ঋণ সম্প্রসারণ না করে মূল্যস্ফীতির হারকে নিচে ধরে রেখেছে। এটা একসময় ১০-১১ শতাংশ উঠেছিল। বহু সাধনা করে ৬-এর নিচে নামানো হয়েছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে এ হার আর রক্ষা করা যাবে না। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ০৩ শতাংশে নেমেছিল। জানুয়ারিতে তা বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দ্রব্যের যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে, তাতে চোখ বুজে বলা যায় মূল্যস্ফীতির হার বাড়বে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। সরকারের গুদামে এখন চালের মজুদ কম। সামনে চৈত্র মাস, যখন ধান-চালের একটা অভাব দেখা দেয়। কৃষকের হাতে এখন চাল নেই। সব চাল চাতালওয়ালাদের কাছে। তারা ইতিমধ্যে নড়েচড়ে বসেছেন। চালের দাম বাড়তির দিকে। শাক-সবজির মৌসুমও শেষ। শীত চলে গেছে। মাছের আমদানিও ধীরে ধীরে কমে এসেছে। অতএব, মূল্যবৃদ্ধি আরও তীব্রতর হবে। এতে বর্তমান গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি আগুনে ঘি ঢালার মতো হবে, তাই নয় কি? আমার ধারণা একটা অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হবে। যদি আসন্ন বাজেটে নতুন কর বসে তাহলে এর ষোলকলা পূর্ণ হবে। ২০১৮-এর নির্বাচনের আগে এ বছরের বাজেটই হবে সরকারের জন্য ‘যুৎসই’ বাজেট। বাজেটের যে আকারের কথা কাগজে এসেছে, তা পাঠ করে মনে হচ্ছে করারোপের আয়োজন চলছে। এ অবস্থায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে আরেক দফা কষ্টের জন্য, যদি না আগামী বাজেটে করারোপের ক্ষেত্রে সৃজনশীল কোনো ধারণা কাজ করে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আগাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটি খারাপ খবর এসেছে। খবরটি রেমিটেন্সের। দেখা যাচ্ছে রেমিটেন্সের পরিমাণ জানুয়ারিতে আরও হ্রাস পেয়েছে। রেমিটেন্স হ্রাসের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সম্পর্ক কী? আলবৎ সম্পর্ক আছে, বড় সম্পর্ক আছে। রেমিটেন্স হ্রাস মানে লাখ লাখ মানুষের আয় হ্রাস। বর্তমানে প্রবাসীর সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। তাদের ওপর নির্ভরশীল লোক কম করে হলেও চার কোটি। অর্থাৎ চার কোটি লোকের খরচ করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আগামী দিনে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? রেমিটেন্স নিয়ে কথা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। কেন রেমিটেন্স কম আসছে তার অনেক কারণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আবার সরকার বলছে, রেমিটেন্স বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এখানেই ‘কারিগরির’ অভাব। যত সহজে গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যায়, তত সহজে রেমিটেন্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে, যাতে সেখানে অধিকসংখ্যক শ্রমিক পাঠানো যায়। প্রধানমন্ত্রী বলছেন শুধু পোশাক রফতানির ওপর ভরসা না রাখতে। রফতানিতে বৈচিত্র্য আনতে তিনি বারবার মন্ত্রীদের, অফিসারদের তাগিদ দিচ্ছেন। বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বন্ধ করার জন্য তিনি তাগিদ দিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ঠিক কাজটিই করে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজগুলো কঠিন। তার ‘সাগরেদরা’ তাই কঠিন কাজে মনোযোগ না দিয়ে সহজ কাজগুলো করে যাচ্ছেন। মন্ত্রীদের কাজ কী? গ্যাসে, বিদ্যুতে যে অপচয় আছে, দুর্নীতি আছে, তা বন্ধ করার দায়িত্ব তাদের। অবৈধ গ্যাস লাইন, বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করা তাদের দায়িত্ব। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র যা আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোকে উৎপাদনক্ষম করার দায়িত্ব তাদের। যেখানে গ্যাস লাইন দেয়া অনুৎপাদনশীল ও লোকসানি কাজ, সেখানে তা বন্ধ করা তাদের দায়িত্ব। এসব কজ কি গ্যাস, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে করছে? আমি নিশ্চিত নই। এ মন্ত্রণালয়ের কাজ শুধু ‘অ্যাকাউন্টিং’ করা নয়। তাদের সামাজিক দায়িত্বের প্রতি নজর দেয়ার কথা। বাজার অর্থনীতির অন্ধ ভক্ত হওয়া এ মন্ত্রণালয়ের একমাত্র কাজ নয়। শিল্পের স্বার্থ দেখা, শিল্পকে প্রতিযোগিতার শক্তি জোগানো, অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করা, মধ্যবিত্তের স্বার্থ দেখাও এ মন্ত্রণালয়ের কাজ। নসরুল হামিদ সাহেব এ বিষয়গুলো নিয়ে আশা করি ভাববেন।

রেমিটেন্সের কথা বলে যে বিষয়টি বোঝাতে চাইলাম তা হচ্ছে, যে অর্থনৈতিক বোঝার সৃষ্টি হচ্ছে, আয় কমলে কীভাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তা বহন করবে? এটি আজকের কথা নয়। জিনিসপত্রের দাম আজ থেকে বাড়ছে না। এ প্রবণতা নতুন নয়। কোনো জিনিসের দামই কমে না। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে না, কমে টাকার ক্রয়ক্ষমতা। টাকার যে ক্রয়ক্ষমতা কমছে তা জলের মতো পরিষ্কার। বাজারে অনেক ধাতব মুদ্রা প্রচলিত থাকার কথা। এক পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা, এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রার অবস্থা কী? এসব বাজারে কি দেখা যায়? পাঁচ টাকায়ও কোনো কাজ হয় না। এর দ্বারা কী বোঝা যায়? বোঝা যায় এসব মুদ্রার উপযোগিতা নেই। তার মানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এটা ‘উন্নয়নের’ বন্ধু। উন্নয়নের বন্ধু হচ্ছে টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস বা মূল্যস্ফীতি। আমরা চাই বা না চাই জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। প্রশ্ন, কোন জিনিসটার দাম বাড়বে এবং কত বাড়বে? চালের দাম ১০০ টাকা কেজি হবে, আটার দাম ১০০ টাকা কেজি হবে, নাকি ধনীর ব্যবহারযোগ্য পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হবে? ভদ্র-সুস্থ সরকার তাই চালের দাম কম রাখে। কারণ এর ওপর মানুষের জীবন, বাঁচা-মরার প্রশ্ন। এখানে মূল কথা অবশ্য আরেকটি আছে। সেটি হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বেতন-ভাতা-মজুরি বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। এটি হলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বিগত ৪৫-৪৬ বছরে মূল্যবৃদ্ধি যেভাবে ঘটেছে, শ্রমিকের মজুরি সেভাবে বাড়েনি।

সাংবাদিক, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, দোকান কর্মচারী, পিয়ন-চাপরাশি ইত্যাদি শ্রেণীর লোকের বেতন-ভাতা সেভাবে বাড়েনি। হিসাব করলে দেখা যাবে বেতন বেড়েছে, মজুরি বেড়েছে হয়তো ২৫ গুণ, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৫০ গুণ। মূল্যবৃদ্ধি এবং বেতন-মজুরি বৃদ্ধির এ তফাৎ মানুষকে দিন দিন অসহায় করে তুলছে। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত হচ্ছে, নিম্নমধ্যবিত্ত হচ্ছে শ্রমজীবী। পাশাপাশি মূলধনের মালিকরা হচ্ছে বড়, বড় থেকে বড়। এ প্রবণতা শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র। উৎকটভাবে পৃথিবীর সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে গুটিকয়েক লোকের হাতে। বাংলাদেশেও তা-ই। এ অবস্থার অবসানকল্পে এবার ধনীদের সম্মেলনেও আওয়াজ উঠেছে। ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের’ সভায় এসব কথা উঠেছে। বাজার ঠিক রাখার জন্য মানুষের আয় ঠিক রাখতে হবে। মানুষ যাতে বাজারে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের রোজগার যাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ে তার দিকে নজর দিতে হবে। করারোপ করতে হবে ধনীদের ওপর। এ আহ্বান এখন জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

যে হাঁস ডিম দেয় (বাজারে যায়) তাকে হত্যা করলে বাজার অর্থনীতি হবে না। বিদ্যুৎমন্ত্রী মহোদয় কি জানেন, বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি ক্রমহ্রাসমান। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ে সেই হারে মজুরি বাড়ে না, বাড়ছে না। মধ্য বয়সে যে লোকের চাকরি যাচ্ছে, তা কি তিনি জানেন? বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের বিক্রি বাড়ছে, কিন্তু লোকের চাকরি সেখানে হচ্ছে না। এ অবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির বোঝা কে বহন করবে, কীভাবে বহন করবে?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

rmdebnath@yahoo.com

http://www.jugantor.com/window/2017/03/05/106271