৪ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১২:৫৬

হজে যেতে পারবেন না ৬১ হাজার লোক

আইটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

প্রাক-নিবন্ধন করার পরও এ বছর প্রায় ৬১ হাজার হজযাত্রী হজে যেতে পারবেন না। এ জন্য হজযাত্রী কোটা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে হজ এজেন্সিদের সংগঠন হাবের নেতারা। এ দিকে দ্বিতীয় বারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেছে হাবসহ হজ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও আইটি প্রতিষ্ঠান বিজনেস অটোমেশন এ অনিয়মের সাথে জড়িত বলে তারা অভিযোগ করেছেন। তবে নিবন্ধন কাজে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন আইটি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

গত বছর থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধন করার নিয়ম চালু করা হয়। ওই বছর দেশের মোট এক লাখ ৪০ হাজার ৯৯৪ জন হজ পালনে ইচ্ছুক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি প্রাক-নিবন্ধন করেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে হজ-ব্যবস্থাপনার সদস্যসহ মোট এক লাখ এক হাজার ৮২৯ জন পবিত্র হজ পালন করার সুযোগ পান। ফলে প্রাক-নিবন্ধন করেও ৩৯ হাজার ১৬৫ জন হজে যেতে পারেননি। এ বছর সৌদি সরকার বাংলাদেশীদের জন্য এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনকে হজে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১০ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যেতে পারবেন। সরকার গত বছরের প্রাক-নিবন্ধন করেও বাদপড়াদের এ বছর হজে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তবে অনেকেই মৃত্যুবরণ করায় তাদের মধ্য থেকে এ বছর ৩৭ হাজার ৪৯৪ জন হজে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে এ বছর নতুন করে বেসরকারিভাবে হজে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে ৭৯ হাজার ৭০৪ জনের। কিন্তু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত মোট এক লাখ ৪১ হাজার ৩০৯ জন হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। ফলে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে প্রাক-নিবন্ধন করেও ৬১ হাজার ৬০৫ জন হজে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। এ কারণে বিষয়টির সমাধানে প্রধানমন্ত্রী ও ধর্মমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাঠানো ওই চিঠিতে হাবের নেতারা হজযাত্রীর কোটা বাড়াতে সৌদি সরকারের সাথে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। চিঠিতে হাবের সভাপতি মো: ইব্রাহিম বাহার বলেন, বর্তমান কোটা বলবত থাকলে ও হজযাত্রী বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হজ-ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। এ জন্য কোটা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

এ দিকে এ বছর হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। হাবসহ হজ এজেন্সিগুলোর বিভিন্ন সংগঠন ধর্ম মন্ত্রণালয় ও আইটি প্রতিষ্ঠান বিজনেস অটোমেশন লিমিটেডের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন তারা।

হজ এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, প্রাক-নিবন্ধন কার্যক্রম অযৌক্তিক, অস্বচ্ছ ও বেআইনি পন্থায় সম্পন্ন হওয়ার কারণেই তারা নিবন্ধনের সিরিয়াল নম্বরে পেছনে পড়ে গেছেন। প্রথম দিকেই হজযাত্রীদের ডাটা এন্ট্রি করে, ব্যাংক ভাউচার প্রিন্ট করে এবং নির্ধারিত ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার পরও ধর্ম মন্ত্রণালয় ও আইটি প্রতিষ্ঠান বিজনেস অটোমেশনের বেআইনিভাবে আকস্মিক বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, কিছু এজেন্সিকে আইন লঙ্ঘন করে ডাটা এন্ট্রির সুযোগ দেয়া, আইটি প্রতিষ্ঠানের অনলাইন সিস্টেমে কারসাজির কারণে তাদের হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধন রহস্যজনকভাবে বিলম্বে হয়েছে এবং তারা সিরিয়ালে পেছনে পড়ে যান। তারা বলেন, এ প্রাক-নিবন্ধন বহাল রাখলে অনেক এজেন্সির বেশির ভাগেরই কোনো হজযাত্রীই এ বছর হজে যেতে পারবেন না। অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘন করে তাদের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রাক-নিবন্ধনের পূর্বঘোষিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এটি অনলাইনে হজের প্রাক-নিবন্ধনের পুরো পদ্ধতিকেই মারাত্মক বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

হাবের পক্ষ থেকে গত ২৬ জানুয়ারি ধর্মমন্ত্রীর কাছে করা এক লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারির সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রাক-নিবন্ধন শুরুর নির্দেশনা দেয়া হয়। এ জন্য যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় তাতে ১৫০ জন হজযাত্রীর টাকা একত্রে জমা দেয়ার নির্দেশ ছিল না। কিন্তু আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে ১৫০ জনের টাকা একত্রে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পরে আবার ১৫০ জন পূর্ণ না হলেও টাকা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

তারা আরো বলেন, ১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে প্রাক-নিবন্ধনের জন্য এজেন্সিগুলো সার্ভার খুলে বসে থাকলেও নিবন্ধনের কাজ শুরু করা হয় দুপুর সাড়ে ১২টায়। এতে কার্যক্রম শুরুর পর এক একটি ডাটা এন্ট্রি করতে ১০-১৫ মিনিট সময় লেগে যায়। সার্ভার এতই ধীর হয়ে যায় যে, কোনো এজোন্সই এ দিন ৪০টি ডাটাও এন্ট্রি করতে পারেনি।

অভিযোগে বলা হয়, ২২ ফেব্রুয়ারি এজেন্সিগুলো ভাউচার ও টাকা নিয়ে ব্যাংকে গেলে ব্যাংক যথারীতি টাকা জমা নেয় এবং অ্যাপ্রুভালের জন্য আইটিতে ইনপুট দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রায় ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বিকেল ৩টা পর্যন্তও বেশির ভাগ এজেন্সি অ্যাপ্রুভাল পায়নি। সকাল ১০টায় টাকা জমা করে বেলা ২টা পর্যন্ত লাইন দাঁড়িয়ে না পেলেও কিছু এজেন্সি ও ব্যাংক ইনপুট দেয়া মাত্রই অ্যাপ্রুভাল পেয়ে যায়। এমনও ঘটনা ঘটে বেলা ১টায় টাকা জমা দিয়ে এক মিনিট পরেই অ্যাপ্রুভাল পেয়ে যায়। এ ব্যাপারে আইটির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললেও তারা সন্তোষজনক কোনো ব্যাখা দিতে পারেননি। অথচ বছরের কোটা পূর্ণ হওয়ার পর বেলা ২টার পর সার্ভার স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপেক্ষায় থাকা সবগুলোর অ্যাপ্রুভাল পাওয়া যায়।

হাব অভিযোগ করে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাঁচ ঘণ্টা সার্ভার হ্যাং করে রেখে আইটির পছন্দের কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের সুযোগ করে দিতেই এ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। এভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, যান্ত্রিক গোলযোগ দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সাইবার অপরাধ করা হয়েছে।

অভিযোগে আরো বলা হয়, বিনা টেন্ডারে নিয়োগ পাওয়া আইটি ফার্ম বিজনেস অটোমেশন অনিয়ম করেই চলেছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো এজেন্সি কথা বললে তাদের হজযাত্রী যেতে পারে না। তাদের অনিয়ম নিয়ে কথা বললে মামলা করা হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় নির্লিপ্ত থেকে তাদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করছে।

ধর্মমন্ত্রীর কাছে দেয়া ওই পত্রে হাবের নেতারা ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার সময় অনুযায়ী সিরিয়াল প্রদান এবং সমতার ভিত্তিতে সব অপারেটিং এজেন্সির মধ্যে কোটা বণ্টনের আহ্বান জানান।

এ ব্যাপারে হাব মেম্বারস কল্যাণ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক মাওলানা জাকির হোসাইন নয়া দিগন্তকে বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং তাদের মনোনীত আইটি ফার্মের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু সাবেক এবং বর্তমান অসাধু দুর্নীতিবাজ আমলা এবং কিছু সংখ্যক হজ এজেন্সি নামধারী মাফিয়া চক্রের সীমাহীন দৌরাত্ম্য, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কবলে জিম্মি হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দেশের হাজার হাজার সরলমনা ধর্মপ্রাণ হজ্বযাত্রী এবং হাজীদের সেবাদানকারী সৎ হজ এজেন্সির মালিকেরা। হজনীতির ধুয়া তুলে প্রতি বছর এ চক্রটি সম্মানিত হজযাত্রী এবং নিরীহ এজেন্সিগুলোকে জিম্মি করে কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধনের নামে বর্তমানে যা হচ্ছে তা হজযাত্রীদের সাথে তামাশা এবং পর্দার আড়ালে অবৈধ অনৈতিক বাণিজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। একই দেশের হজযাত্রীকে সরকারি-বেসরকারি এবং আলাদা কোটা সৃষ্টি করে বিভক্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন লোভ-লালসা এবং কোটা খালি দেখিয়ে অনিচ্ছুক হজযাত্রীদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ে সরকারিভাবে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর পেছনে ও অন্তরালেও রয়েছে মোটা অঙ্কের অবৈধ বাণিজ্য। হজ্বযাত্রীদের নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো নিয়মনীতি তৈরি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে সহজ সুন্দর সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনাকে জটিল কঠিন এবং দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে। যে কাজ মাত্র সাত দিনে করা সম্ভব বিভিন্ন সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা, অজ্ঞতা ও অহেতুক অজুহাত দেখিয়ে তা বাস্তবায়নে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়া হচ্ছে। অবশেষে তাড়াহুড়া ও গোঁজামিল দিয়ে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হজযাত্রী এবং নিরীহ হজ এজেন্সিগুলোকে অহেতুক ঝামেলা, অনিশ্চয়তা ও বিড়ম্বনার মধ্যে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তারপর বলা হচ্ছে কোনো ত্রুটি সহ্য করা হবে না। নিরীহ হজ এজেন্সিগুলোর অবস্থা দাঁড়িয়েছে ‘হাত পা বেঁধে সাঁতার কাটতে’ বলার মতো। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত হজ ব্যবস্থাপনাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতিবাজ সাবেক ও বর্তমান আমলা এবং মাফিয়া চক্রের কবলমুক্ত করা না হবে ততদিন হজযাত্রী এবং নিরীহ হজ এজেন্সিগুলোর দুর্ভোগ ও দুঃসহ যন্ত্রণা লাঘব হবে না।

হাব সমন্বয় পরিষদের সদস্যসচিব রেজাউল করিম উজ্জ্বল বলেন, হজ আইটি বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের সার্ভার থেকে কয়েকটি বিশেষ মহলকে (এজেন্সি) সুবিধা দিয়েছে। আইটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিজনেস অটোমেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ হাসান মিতুল নয়া দিগন্তকে বলেন, হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধনে পক্ষপাতমূলক কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়নি। ১৫০ জনের কোটা নিয়ে যে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া কোনো এজেন্সি ও ব্যাংককেও বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়নি। যে ব্যাংক বেশি ইউজার ব্যবহার করেছে তারা বেশি অ্যাপ্রুভাল পেয়েছে। বিষয়টি ব্যাংকে খোঁজ নিলেই পাওয়া যাবে। তিনি অভিযোগ করেন, একটি চক্র বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/200656