২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ১২:০০

স্কুলের শতবর্ষ উদ্‌যাপনে কোটি টাকার চাঁদাবাজি

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা সদরের স্টেশন রোড বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চা দোকানদার কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমি সামান্য পুঁজি খাটিয়ে শ্রম দিয়ে ব্যবসা করে সংসার চালাই। আমার কাছ থেকে বুলবুল চেয়ারম্যান লোকজন নিয়ে এসে এক হাজার টাকা নিয়ে গেছেন।
আমি ৫০০ টাকা দিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করেছিলাম; কিন্তু তিনি শোনেননি। ’ এভাবে বাজারের ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক, চাতাল মিল মালিক ও ডিলার, হাসপাতাল, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ উপজেলার সব সরকারি-বেসরকারি দপ্তর এই চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
নেত্রকোনার খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পূর্বধলা জগত্মণি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানের নামে এই চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুষ্ঠানের ‘ব্যয় মেটাতে’ প্রায় কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। কেউ অভিযোগ করেছে, তিন লাখ টাকার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামছেন নেতারা। উৎসব উদ্যাপন কমিটিতে থাকা বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এ চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানই চাঁদাবাজির আওতার বাইরে নেই। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের অনেকে।
কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক জানান, এ উৎসব বাবদ তাঁদের পাঁচ হাজার টাকা করে চাঁদা দেওয়ার জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলে দিয়েছেন। তাই নিরুপায় হয়ে তাঁরা এই হারে টাকা দিচ্ছেন। তবে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল বারী বলেন, নির্দিষ্ট অঙ্কে কোনো প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।
কয়েকজন ভুক্তভোগী ও উৎসব উদ্যাপন কমিটি-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটিতে থাকা পূর্বধলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম ওরফে সুজন, পূর্বধলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সমর্থক সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর মেম্বারসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি উৎসবের খরচ জোগাতে তালিকা করেন। সেই তালিকা ধরে টাকা তোলা হচ্ছে।
অটো চাতালকল মালিক আজিজ মোড়ল বলেন, ‘আমাদের রাইস মিল মালিক প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা, চাতালকল মালিক ও চালের ডিলার প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। এ টাকা দেওয়ার জন্য উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মো. মোয়েতাছেমুর রহমান আমাদের মৌখিকভাবে বলেছেন। ’ তবে খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, প্রস্তুতি কমিটির সভায় উপজেলার সব কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সব বিভাগে কিছু সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। চাপ দিয়ে টাকা নেওয়া হয়নি।
স্টেশন রোড বাজারের রঙের দোকানদার বিজয় চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমাকে গত রবিবার রাতে দুই হাজার টাকার চাঁদার রসিদ দিয়েছে। আমি এক হাজার টাকা দিতে চেয়েছি। কিন্তু চেয়ারম্যান কাক্কু (বুলবুল) বলেছেন ১৯৯৯ টাকা দিলেও হবে না। ’ তিনি বলেন, বিএনপির আমলে যারা আগে চাঁদাবাজি করেছিল, এখন তারাই আওয়ামী লীগে ঢুকে চাঁদাবাজি করছে।
এভাবে চাঁদা আদায়ের বিষয় নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করে। পূর্বধলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা। এটা উদ্যাপন অনুষ্ঠানের সহায়তা, চাঁদাবাজি যা-ই বলেন, বলতে পারেন। ক্ষমতা থাকলে যা পারা যায় তা-ই। ’
উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে গর্ব বোধ করি। কিন্তু যেভাবে চাপ দিয়ে টাকা নেওয়া হচ্ছে, তাতে লজ্জা বোধ করছি। ’ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির মণ্ডল বলেন, এভাবে চাঁদাবাজি করে টাকা তোলায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ওষুধ ব্যবসায়ী ওয়াহিদুজ্জামান আজাদ বলেন, ‘আমাকে ২৫ হাজার টাকার রসিদ দিয়েছে। আমি এখনো টাকা দিইনি। কী যে হবে জানি না। ’
তবে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান বুলবুল তাঁর বিরুদ্ধে আনা চাঁদাবাজির অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট দাবি করে বলেন, ‘সবাই খুশি হয়ে যে যা দিচ্ছে তা-ই নিচ্ছি। কেউ যদি বলেন, টাকা দিয়ে কষ্ট পেয়েছে, তাহলে তাঁর টাকা ফেরত দেব। মাত্র ২১৫ জন ব্যবসায়ীকে টাকা ধরা হচ্ছে। ’ তিনি বলেন, অনেক টাকার প্রয়োজন। মোট ৩৫ লাখ টাকা হয়েছে প্রায়।
পূর্বধলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, কাউকে টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যে যেমন পারছে, তেমনি দিচ্ছে। প্রতিপক্ষের লোকজন এমন অপবাদ রটাচ্ছে।
জগত্মণি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উদ্যাপন কমিটির সদস্যসচিব সুধাংশু শেখর তালুকদার বলেন, ‘একশত বছরের একটি স্কুল, একশত বছরের একটি অনুষ্ঠান। এর খরচ জোগানো একটি বড় ব্যাপার। এগুলো প্রাক্তন ছাত্রদের দিয়েই হয়ে থাকে। এর বেশি কিছু নয়। এখানে পক্ষ, প্রতিপক্ষ আছে। তারা এ রকম অভিযোগ করছে। কাউকে কোনো চাপ দিয়ে টাকা আদায়ের কথা বলা হয়নি। খুশি হয়ে যে যা দেবে, তা-ই আনতে বলা হয়েছে। ’
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি ও শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের সঙ্গে বারবার তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, তালিকায় উপজেলার প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ৫০০ টাকা, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আলিয়া মাদ্রাসাকে পাঁচ হাজার টাকা, পূর্বধলা ডিগ্রি কলেজ ও শ্যামগঞ্জের হাফেজ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজকে এক লাখ টাকা, পূর্বধলা রাবেয়া আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজকে ৫০ হাজার টাকা, ১৮ জন সার ডিলারের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা, ছয়টি রাইস মিলের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা, ৫৫টি চাতাল মিল মালিকের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা, ২২ জন চালের ডিলারের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা, হাসপাতাল স্টাফ সম্মিলিতভাবে দুই লাখ টাকা, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়, সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ উপজেলার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়া পূর্বধলা বাজারের ব্যবসায়ীরা সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা প্রদানের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে রেজিস্ট্রেশন বাবদ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫০০ ও ২০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2016/12/29/446332