৩ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২৭

বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া

নৌমন্ত্রীর কাছে জিম্মি সরকার!

সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সরকারকে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে’

পরিবহন খাতে বিভিন্ন সময়ে অস্থিরতার নেপথ্যে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বিশেষ ভূমিকা রাখেন- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। মঙ্গল ও বুধবার শ্রমিক আন্দোলনের নামে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে নৈরাজ্য সৃষ্টির ঘটনায় নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের কর্মকাণ্ডের কাছে কি জিম্মি সরকার? পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রক কে- শাজাহান খান নাকি সরকার? খোদ সরকারি দলের নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনীতিকসহ পেশাজীবীদের মধ্যে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে সমালোচনার ঝড়। কিন্তু শ্রমিকদের বারবার ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে নিজ দলের সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পরও তার বিরদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকছে আওয়ামী লীগ। তবে অনৈতিক ও অযৌক্তিক দাবি আদায়ে পরিবহন শ্রমিকদের দিয়ে যারা সারা দেশ অচল করে দেয়, সেসব নেপথ্যের নায়কের বিরুদ্ধে এখনই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। অন্যথায় ভবিষ্যতে সরকারকে বড় ধরনের মাশুল দিতে হতে পারে বলে আশংকা তাদের।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, একজন মন্ত্রীর বাসায় (শাজাহান খান) ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে আরেকজন প্রতিমন্ত্রীও (মশিউর রহমান রাঙ্গা) উপস্থিত ছিলেন। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সরকার, জনগণ ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ফেলেছেন তারা। ধর্মঘটে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ জনগণ। ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। গাড়ি চলাচল না করায় শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারেনি, কর্মজীবীরা কর্মস্থলে যেতে পারেননি। রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুর করা হয়েছে। এসব একেবারে কাম্য নয়, এটা প্রত্যাশা করা যায় না। এ ধরনের কর্মসূচি জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সরকার বেকায়দায় পড়েছে। পুলিশকে আক্রমণ করা হয়েছে।

নৌমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘সড়কে মানুষ হত্যার জন্য আদালত দু’জন চালককে সাজা দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী ওই সাজার বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনিভাবে মোকাবেলা না করে আমাদের সরকারের একজন মন্ত্রীর (শাজাহান খান) নেতৃত্বে কিছু পরিবহন শ্রমিক জনগণকে জিম্মি করে যে নৈরাজ্যকর আন্দোলন করেছে, তাতে সরকারের সুনাম নষ্ট হয়েছে। এ ধরনের আন্দোলন কাম্য নয়। আন্দোলনকারীরা শক্তির রাজনীতি করছে, জনগণের শান্তির জন্য নয়।’

১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-আম্বিয়া)-এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না বলে শাজাহান খান যে মন্তব্য করেছেন তা নৈরাজ্যবাদীদের প্রশ্রয় দেবে, তাদের উৎসাহিত করবে। সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তিনি বলেন, আদালতের রায় নিয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু রায় বাতিলের দাবিতে রাজপথে নেমে যাওয়া খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ ধরনের কর্মসূচি আইনের শাসনের পরিপন্থী।

শ্রমিক সংগঠনগুলো সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে বেশ কয়েকবার আঞ্চলিক ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। কখনও কখনও জাতীয়ভাবে এ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ওইসব কর্মসূচিতে কখনও ১১ দফা, কখনও সাত দফা, আবার কখনও ১৫ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। পরে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের উপস্থিতিতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশেষ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে দাবি আদায়ে সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা চাপ সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে অনেকবার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দাবি অনেক থাকলেও মূলত যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া চালকদের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, দুর্ঘটনা ঘটানো চালকদের রক্ষা, পরিবহন খাতের চাঁদা কত হবে তা নির্ধারণ এবং সরকারি সংস্থা বিআরটিসির সেবা সংকুচিত করা নিয়ে সরকারের ওপর বিভিন্ন সময় চাপ ছিল শ্রমিক ফেডারেশনের। এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এসব দাবি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেন।

ওইসব দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ধর্মঘট বা কর্মবিরতি কর্মসূচি। এমনকি ডাকাতির মামলায় চালক আটকের ঘটনায়ও আঞ্চলিক ধর্মঘট করেছেন শ্রমিকরা। আর মাশুল গুনতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অশিক্ষিতদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার দাবি জানিয়ে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট নৌ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের শাজাহান খান বলেছিলেন, দেশে চালকের সংকট থাকায় অশিক্ষিতদের চালকের লাইসেন্স দেয়া দরকার। কারণ তারা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চেনে।

আরও জানা গেছে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দাবি ওঠে, চালকের অবহেলায় প্রাণহানি হলে ‘নরহত্যার’ অভিযোগে মামলা করতে হবে। ওই সময়ে সারা দেশে ছয়টি মামলাও হয় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০২ ধারায়। এরপরই শাজাহান খানের নেতৃত্বে শ্রমিক নেতারা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কাছ থেকে ৩০২ ধারায় মামলা না নেয়ার আশ্বাস আদায় করেন। ৩০২ ধারা অজামিনযোগ্য এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু শাজাহান খানসহ শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩০৪(খ) ধারায় এসব মামলা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিক নেতারা জানান, সরকার মিশুকের পরিবর্তে ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা বরাদ্দের উদ্যোগ নিলে সেখানে শাজাহান খানের সংগঠন শ্রমিক ফেডারেশন ভুয়া মালিকদের পক্ষ নেয়। ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের মধ্যে বরাদ্দের নীতিমালা করলেও বিআরটিএ’র নথিতে নেই এমন মালিকদের মধ্যে তিন শতাধিক অটোরিকশা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় বিআরটিএ।

আরও জানা গেছে, পরিবহন খাতে চাঁদার বৈধতা দেয়ারও দাবি তোলেন শাজাহান খান। এ জন্য প্রজ্ঞাপন জারিরও প্রস্তাব দেন তিনি। এতে ঢাকায় মালিক-শ্রমিকের জন্য ৭০ টাকা এবং শুধু ঢাকার বাইরে শ্রমিকদের জন্য ২০ টাকা চাঁদা আদায়ের বৈধতা পেতে বিভিন্ন বৈঠকে দফায় দফায় চাপ প্রয়োগ করেন। অবশেষে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ওই চিঠি নাকচ হলে এবং এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হলে বিষয়টি আর এগোয়নি। কিন্তু এখনও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ টাকা নেয়া হয় শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে।

একাধিক শ্রমিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফেডারেশনের নামে যে চাঁদা তোলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ, সংগঠন পরিচালনায় খরচের জন্য শ্রম আইনে যে চাঁদার কথা বলা হয়েছে, তা দৈনিক নয়, মাসিক কিংবা বার্ষিক। এ ছাড়া ফেডারেশন সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়কারী বা কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাই ফেডারেশন সরাসরি প্রতিটি বাস থেকে চাঁদা তুলতে পারে না। কেবল শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে মাসে বা বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা নিতে পারে ফেডারেশন। এখন ফেডারেশন ও শ্রমিক ইউনিয়ন আলাদাভাবে প্রতিদিন ও প্রতি গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য নিতে বৃহস্পতিবার নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের দুটি মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু রিং বাজলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া এদিন রাত সাড়ে ৭ টায় তার টেলিটক মোবাইল ফোন নম্বরে মন্তব্য চেয়ে একটি এসএমএস পাঠানো হয়। রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এসএমএস-এর উত্তর পাওয়া যায়নি।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/03/105598