৩ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২২

নিরপেক্ষ নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার

অধ্যাপক ড. এস এম হাসান তালুকদার

যদি গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে বলি তবে বলতে হয়Ñ গণতন্ত্র বিপন্ন, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকারি দল মিছিল মিটিং করতে পারলেও প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে তা করতে দেয়া হচ্ছে না। ডজন ডজন মিথ্যা মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের জেলে পুরে রাখা হচ্ছে। কিংবা হয়রানি করা হচ্ছে।

যদি মানবাধিকার এর কথা বলি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ক্রসফায়ার, গুম এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১৬ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ১৯৫ জন, গুম ও গুপ্ত হত্যা হয়েছে ৯৭ জন। এদের অনেকেই বিরোধী দলের বিশেষত বিএনপির নেতাকর্মী।

যদি গণমাধ্যমের কথা বলিÑ সরকারের সমালোচনা করে এমন পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে, টিভি চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে। মিডিয়াকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করার নিমিত্তে অনেকগুলো আইন করা হয়েছে কিংবা আইন করা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যেমন : ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৬ (প্রস্তাবিত); লিবারেশন ওয়ার ক্রাইম ডিনায়েল অ্যাক্ট, ২০১৬ (প্রস্তাবিত); ব্রডকাস্ট অ্যাক্ট, ২০১৬ (প্রস্তাবিত), ইত্যাদি যা মিডিয়াকে একটা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে রেখেছে। আর সাংবাদিক নির্যাতন গত দুই বছরে সংঘটিত হয়েছে ৩৬১টি। অর্থাৎ প্রতি ২ দিনে ১টি। প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৪তম।

আর সবশেষে এখন আরেকটি বিষয় আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছেÑ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা। আমি প্রথমে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে তুলনামূলক সাংবিধানিক অবস্থান তুলে ধরছি।
প্রথমত নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রেক্ষাপট- শ্রীলঙ্কা :
Article 41, 19th Constitutional Amendment
রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেন Constitutional Council-এর সুপারিশক্রমে।
Constitutional Council-এর গঠন : মোট ১০ জন
(১) স্পিকার থাকেন Council-এর প্রধান হিসেবে। আর সদস্য হিসেবে থাকেনÑ
(২) প্রধানমন্ত্রী
(৩)বিরোধী দলের নেতা
(৪) রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন এমপি
(৫) প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের সুপারিশকৃত ০৫ জন, যার মধ্যে ২ জন এমপি থাকবেন এবং
(৬) অন্য একজন।
এখানে লক্ষণীয় যে, শ্রীলঙ্কার Constitutional Council -এর অধিকাংশ সদস্যই সরকার ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়।

নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রেক্ষাপট-পাকিস্তান :
Articles 213 and 218
রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেন ১২ সদস্যের পার্লামেন্টারির সুপারিশক্রমে। উক্ত পার্লামেন্টারি কমিটিতে সরকারি দলের ০৬ এবং বিরোধী দলের ০৬ জন সংসদ সদস্য থাকেন।
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা বিরোধী দলের নেতা এর সাথে পরামর্শ করে নির্বাচন কমিশনারদের (প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ) প্রতি পদের বিপরীতে ০৩ জনের নাম পার্লামেন্টারি কমিটিতে পাঠান। কমিটি উক্ত ০৩ জনের মধ্য থেকে একজন করে চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠান এবং সে মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
বস্তুত এক্ষেত্রে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য ও ভারসাম্য দুটোই কাজ করে।

নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রেক্ষাপট-বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ মতেÑ রাষ্ট্রপতি, প্রণীত আইন সাপেক্ষে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য। অর্থাৎ সবই চূড়ান্ত হবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এখানে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা নেই।

এবার আসা যাক সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত প্রণীত আইন প্রসঙ্গেÑ বাস্তবে, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও সেই আইন প্রণীত হয়নি। অর্থাৎ আইন নেই। তবে দু’বার (গতবার ও এবার) রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (১ জন) ও নির্বাচন কমিশনার (৪ জন) মোট ৫ জনের নিয়োগ দেন সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত ১০ জনের মধ্য থেকে। সার্চ কমিটি প্রতি পদের বিপরীতে ২ জনের নাম প্রস্তাব করেন। তবে সবই চূড়ান্ত হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। উল্লেখ্য যে, এই সার্চ কমিটিও চূড়ান্তভাবে গঠিত হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন এবং সার্চ কমিটি গঠনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ চূড়ান্ত এবং রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যতামূলক। এখানে রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির পরামর্শ গ্রহণ রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এটি একটি আইওয়াস মাত্র।

বাংলাদেশে সরকারি দল ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো বা বাধ্যবাধকতা নেই। চূড়ান্ত অর্থে সবই সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

ফলত অতি সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে গঠিত সার্চ কমিটির সবাই নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন না এবং তারই স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে একইভাবে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনেও নিয়োগপ্রাপ্ত সবাই গ্রহণযোগ্য হননি। বিতর্কিত ব্যক্তিও স্থান পেয়েছেন।

এবার আসা যাক নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে আইনের জগতে, জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে সাধারণত ৩ ধরনের কেয়ারটেকার সরকারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।

একটি হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরা নির্দলীয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না এবং প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯৬ সালে এ জাতীয় প্রবর্তন করেছিল।

আরেকটি হচ্ছে, পরবর্তী সরকার। নির্বাচনের প্রাক্কালে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এ জাতীয় সরকার দলীয় এবং নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, দলের পক্ষে প্রচারণা করতে পারেন।

আর তৃতীয়টি হচ্ছে সর্বদলীয় সরকার। এ জাতীয় সরকার বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয়। এরা দলীয় এবং নির্বাচনে অংশ নিতে ও দলের পক্ষে প্রচারণা চালাতে পারেন।

এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে, বাংলাদেশে ইতঃপূর্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের বিভাজিত রায়ে নির্দলীয় ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় বর্তমান সংবিধান মতে পরবর্তী সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের প্রাক্কালের সরকারই দেশ পরিচালনা করবেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদ মতে, আমাদের জাতীয় সংসদের মেয়াদ সংসদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ থেকে ০৫ বছর। আর এ হিসাবে বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে, সম্ভবত ২৯ জানুয়ারি।

আর সেক্ষেত্রে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ মতে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার অর্থাৎ ২৯ জানুয়ারি ২০১৯-এর পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। আর সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ মতে, ঐ নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেননা, ৫৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।

মোট কথা, ওই নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণ তাদের পদে বহাল থাকবেন এবং সে মোতাবেক তাদের সকল সাংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রার্থী যারা মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য নন তারা সেই অধিকার বা সুবিধা পাবেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ তা হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বাস্তবে কিভাবে হবে? উত্তর হচ্ছেÑ বাস্তবে হবে না, সম্ভব নয়। সাধারণ আইন করে মন্ত্রী বা সাংসদদের সাংবিধানিক অধিকার বা সুবিধা বাদ দেয়া যাবে না। বরং সংবিধানের পরিপন্থী কোনো আইন বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

অতএব, এক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন অথবা মন্ত্রী/সাংসদগণ বাস্তবে তাদের সাংবিধানিক সুবিধা গ্রহণ করবেন না এমন ঐকমত্যের প্রয়োজন অথবা সংসদ বাতিল করে নির্বাচন দিতে হবে। বস্তুত, এসব বিষয়ে এখনই আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ০৫ জনের নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন করা কখনোই সম্ভব নয় যদি সরকার হস্তক্ষেপ নিরপেক্ষ না হয় কিংবা সরকারের মধ্যে সেই লক্ষ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স না থাকে। কেননা বর্তমানে প্রশাসনের সর্বস্তরে আওয়ামী দলীয়করণ এমন এক পর্যায়ে গেছে যেখানে নির্বাচনে দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরকে কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রকাশ্যে সিল মারতে দেখা যায়। তাদের আচরণ এখন দলীয় পেটোয়া বাহিনীর মতো।

গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা দেখলাম, সরকারি দলের প্রতিপক্ষ বিশেষত বিএনপির বহু প্রার্থী বাধার কারণে মনোনয়ন দাখিল করতে পারেননি। সমাধান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিয়ম করল যে, অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেয়া যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, অবস্থা যেখানে এত খারাপ, অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল করতে হয়, সেখানে অবাধ প্রচার/প্রচারণা, সুষ্ঠু ভোট এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিভাবে নিশ্চিত হবে? ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ইতিহাসের নিকৃষ্ট মানের নির্বাচন হয়েছে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যদি নির্বাচনকালীন সরকার হয় তবে কোনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।

এটি সম্ভব নয় এজন্যই যেÑ এ দলটির জন্য গণতন্ত্র মুখ্য নয়, ক্ষমতাই মুখ্য। দলটি এখন এদেশে সবচেয়ে উশৃঙ্খল ও বিপজ্জনক দল। গত দুই বছরের হিসাবে, আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব মতে, এ দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষমতা আর অর্থের জন্য পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ৩৬২ বার। এতে মারা যায় ৫৯ জন এবং আহত হয় ৩৮৫৯ জন। অতএব, ক্ষমতার জন্য সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এ দলটি সরকারের আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে অপর দলের ওপর কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই দল, আওয়ামী লীগ সরকার হচ্ছে সেই সরকার, গণতন্ত্রের প্রশ্নে যাদের রেকর্ড সুখকর নয়। অতীতে ১৯৭৩ সালের ভোট ডাকাতির সংসদ নির্বাচন, ১৯৭৫ সালের একদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন, ২০১৪ সালের নজিরবিহীন প্রহসনের সংসদ নির্বাচন আমাদেরকে সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

আওয়ামী লীগ সরকার হচ্ছে সেই সরকার যারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে বলেছিল এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই নির্বাচন দেবেন এবং দুই/আড়াই বছরের মধ্যে। কিন্তু এখন তারা সে বক্তব্য থেকে সরে গিয়েছেন। ক্ষমতার প্রতিযোগিতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যদিও নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন এবং ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন হয় অসহায় এবং অকার্যকর নতুবা সরকারের অগণতান্ত্রিক ইচ্ছার ক্রীড়নক।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনকালীন এমন একটি সরকার গঠনের প্রশ্ন সামনে এসেছে, যে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ব্যবস্থা থাকবে। অবশ্য এমনটি করার লক্ষ্যে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যত সর্বদলীয় আদলের সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন। কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, প্রধানমন্ত্রীর সেই কথা তারই যথার্থতা প্রমাণ করে।

কিন্তু বর্তমান সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ মতে, প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এবং তাহার কর্তৃত্বে প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই মুখ্য। আবার ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলতে পারেন। মন্ত্রী অনুরূপ পালনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ওই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্বের অবসান করবেন অর্থাৎ তার নিয়োগ বাতিল করবেন। অতএব, বর্তমান সংবিধানের অধীনে সর্বদলীয় সরকার কিংবা সহায়ক সরকার (যে নামেই বলি না কেন) গঠিত হলেও মূল ক্ষমতা থাকবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এবং তার নির্বাহী ইচ্ছাই মুখ্য। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সর্বদলীয় সরকার বা সহায়ক সরকার হলেও সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার অবসান প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন জরুরি অথবা প্রধানমন্ত্রী তার এই একক ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না এই মর্মে ঐকমত্য প্রয়োজন।

তাই এক্ষণে সেই লক্ষ্যে আলোচনা প্রয়োজন। আলোচনা প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং সরকারের সাথে। সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই সব দলকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি বন্ধে জনমত গঠনের। উদ্যোগ নিতে হবে সিভিল সোসাইটিকে সেই লক্ষ্যে সংগঠিত করার। উদ্যোগ নিতে হবে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোকে, নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সহায়ক সংস্থাকে সক্রিয় করার। উদ্যোগ নিতে হবে সকল গণতান্ত্রিক দলকে সুসংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ করার। উদ্যোগ নিতে হবে প্রেস এবং মিডিয়াকে সংগঠিত ও তৎপর করার। উদ্যোগ নিতে হবে উক্ত লক্ষ্যসমূহ পূরণে কার্যকর কৌশল তৈরিতে এবং সেই লক্ষ্যে গবেষণার। আর তবেই সফল ও প্রত্যাশিত অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত হবে এবং নির্বাচনে কাঙ্খিত ফল আসবে; নতুবা নয়।

লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/200307