২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:১৩

নজিরবিহীন

আশ্চর্য। বিস্ময়কর। অভাবনীয়। অচিন্তনীয়। নজিরবিহীন। মানুষ মারার লাইসেন্স দিতে ধর্মঘট! অবাক করা বিষয়। আর এ ধর্মঘটে যদি থাকে মন্ত্রীর সমর্থন তাহলে তো কোনো কথাই নেই। মহাসড়কে, ফ্লাইওভারে এলোপাতাড়ি গাড়ি রেখে চালকরা চাবি নিয়ে চলে যায়। ফলে বন্ধ যানচলাচল। দুর্ভোগ জনগণের। আটকা পড়ে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও। কোথাও কোথাও অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে রোগীকে। এতসব কেন? কারণ একটাই আদালতের রায় বদলাতে হবে। এ দাবি নিয়ে দুই দিনে সড়ক, মহাসড়কে ঘটেছে লঙ্কাকাণ্ড। এ ধর্মঘট ডেকেছে সরকার সমর্থক পরিবহন মালিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। আদালতের রায় বদলানোর দাবিতে এমন ধর্মঘট বিরল। ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয়ার মতো ঘটনা।

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, মন্ত্রীর বাসায় বসেই ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটা তো আরো ভয়ানক খবর। ধর্মঘটের প্রথম দিন গাবতলীতে পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশবক্স পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে দেশবাসী এমন ধর্মঘট কিংবা হরতাল দেখেনি। বিরোধী দল হরতাল ডাকে না অনেকদিন। আবার মঙ্গলবার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে আধাবেলা হরতাল ডাকা হয়েছিল বাম দলগুলোর তরফে। তাদের শাহবাগ মোড়ে দাঁড়াতেই দেয়নি পুলিশ। অথচ সরকারি ধর্মঘটে দেশ অচল। এ ধর্মঘটকে সেতুমন্ত্রী দেখছেন অযৌক্তিক হিসেবে। আর আইনমন্ত্রী বলেছেন, রায়ের বিরুদ্ধে কারো কোনো কথা থাকলে আদালতেই যেতে হবে। রাজপথে নয়। আর নৌ-মন্ত্রী বলেছেন, চালকরা মনে করছেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ বা যাবজ্জীবনের মতো রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। তাই তারা অবসরে গেছেন। প্রশ্ন হলো- রায়ের বিরুদ্ধে এভাবে ধর্মঘট ডাকা কি আদালত অবমাননা নয়? রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট না ডেকে মন্ত্রী যদি সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতেন তাহলে জনসমর্থন পেতেন। মানুষ খুশি হতো। দীর্ঘদিন ধরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন নিয়ে রাজপথে সক্রিয়। কই মন্ত্রীতো সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কোনো উদ্যোগ নেননি। এ কারণেই হয়তো প্রতিদিন যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। ঝরছে প্রাণ।

গতকাল প্রকাশিত নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে ভয়ঙ্কর চিত্র দেখা গেছে। এতে দেখা যায় ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১৫ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ে গড়ে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন মহাসড়ক, জাতীয় সড়ক, আন্তঃজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। আর জানুয়ারিতে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছে ১৩ জন। আর দুর্ঘটনা ঘটেছে দিনে ১১টি।

পরিসংখ্যানে ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৮ দিনে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬ জন নারী ও ৫৮ শিশুসহ ৪২৭ জন নিহত এবং এক হাজার ৯৪ জন আহত হয়েছেন। আর জানুয়ারি মাসে ৩৫০টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৬ জন ও আহত হয়েছেন ১০১২ জন। সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। এ প্রসঙ্গে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে দূরপাল্লার গাড়িগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, গাড়ি চালানোর সময় চালকদের অদক্ষতা-অসতর্কতা, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিয়ে দীর্ঘ সময় একটানা গাড়ি চালানো, চালক ও সহকারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাব, ওভারটেকিংয়ের ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, বিভিন্ন স্থানে যানজটে নষ্ট হওয়া সময় পুষিয়ে নিতে ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, সড়ক পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ ও তদারককারী সংস্থাগুলোর যথাযথ দায়িত্ব পালনে ঘাটতি এবং আইন লঙ্ঘনকারী গাড়িগুলোর চালক, সহকারী ও মালিকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।

২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের জোকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও প্রখ্যাত সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় করা মামলার রায়ে সম্প্রতি মানিকগঞ্জের একটি আদালত ঘাতক বাসটির চালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এছাড়া, ২০০৩ সালে সাভারে ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাকচাপা দিয়ে এক গৃহবধূকে হত্যার দায়ে সোমবার ঢাকার একটি আদালত ওই চালকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

এ দুটি রায়ের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ জনগণ এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। সরকার সমর্থক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের ডাকা এ ধর্মঘটে হতবাক সবাই। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এভাবে ধর্মঘট ডেকে গোটা দেশ অচল করে দেয়া নজিরবিহীন ঘটনা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=55685