পুলিশের গুলিতে গাড়িচালক নিহত হওয়ার পর গাবতলীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে পরিবহন শ্রমিকদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ; ইনসেটে নিহত চালক ; পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান
২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:০২

পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহত রাজধানীর গাবতলী রণক্ষেত্র

দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ

রাজধানীর গাবতলী এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের সাথে পুলিশ ও র‌্যাবের দফায় দফায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে অর্ধশত। এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের হাতে এ সময় বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ চরম লাঞ্ছনার শিকার হন।

গতকাল সকাল পৌনে ১০টায় শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ও র‌্যাব যৌথভাবে অভিযান শুরু করেন। এ সময় তারা গুলি চালালে শাহ আলম (৩২) নামে এক বাসচালক গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় ডা: সেলিনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসকেরা তাকে ফিরিয়ে দেন। পরে শ্রমিকেরা মৃত ভেবে শাহ আলমকে নিয়ে আবার গাবতলী টার্মিনালে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ শাহ আলমকে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে বেলা সাড়ে ১১টায় চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনায় আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাত থেকেই গাবতলী বাস টার্মিনালে পরিবহন শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ বাধা দিতে গেলে রাত ৮টায় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ধাওয়া করলে তারা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের একটি রেকার ভ্যান ও গাবতলী টার্মিনালে থাকা অস্থায়ী পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও থেমে থেমে সারা রাত চলতে থাকে বিক্ষোভ।

গতকাল সকাল থেকে গাবতলী এলাকায় জড়ো হতে থাকেন শত শত পরিবহন শ্রমিক। বেলা বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা একত্র হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেন। মাজার রোডের মোড় থেকে আমিনবাজার ব্রিজের গাবতলী সীমানা পর্যন্ত দখল নিয়ে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সসহ অর্ধশত যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। একপর্যায়ে ওই রাস্তা দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমপর্যায়ে শ্রমিকদের দাপটের কাছে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ। পরে সকাল সাড়ে ৯টায় মিরপুর জোনের ডিসি মাসুদ আহমেদ খানের নেতৃত্বে পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা বিুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে অভিযান শুরু করেন। এ সময় শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ। পুলিশ মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাস শেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকেন। শ্রমিকেরাও ইট-পাটকেল-লাঠি নিয়ে ছোটাছুটি করেন। এ সময় গোটা গাবতলী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের কারণে শ্রমিকেরা পিছু হটতে শুরু করেন।

একপর্যায়ে তারা সংগঠিত হয়ে আবার পুলিশের ওপর হামলা চালান। পুলিশও পাল্টা গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করেন। গুলি ও টিয়ার শেলের শব্দে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে। সকাল পৌনে ১০টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে শাহ আলম নামে এক শ্রমিক আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। এ সময় শ্রমিকেরা পিছু হটে যান। একপর্যায়ে কয়েকজন শ্রমিক আহত শাহ আলমকে উদ্ধার করে স্থানীয় সেলিনা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা শাহ আলমকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা সোহওরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন।

সেলিনা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘রোগী আনার পর আমরা তার নাড়ির স্পন্দন (পালস) পাইনি। আবার অথরাইজড চিকিৎসক ছাড়া তাকে মৃত ঘোষণা করাও সম্ভব নয়। তাই রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। রোগীর পালস পাওয়া গেলে প্রাথমিকভাবে তার চিকিৎসা করা সম্ভব হতো।’ এতেই শ্রমিকেরা ধরে নেন শাহ আলমের মৃত্যু হয়েছে। তারা ুব্ধ হয়ে মুমূর্ষু শাহ আলমকে নিয়ে হাসপাতালে না গিয়ে আবার গাবতলী গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে শাহ আলমকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চিকিৎসক শাহ আলমকে মৃত ঘোষণা করেন। তার লাশ একই হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়।

জানা গেছে, শাহ আলম বৈশাখী নামক একটি পরিবহনের চালক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী। তবে সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতের স্বজনেরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে যাননি।

মিরপুর জোনের ডিসি মাসুদ আহমেদ বলেন, পরিস্থিতি শান্ত করে সাধারণ যানবাহন চলাচলের জন্য কাজ করেছে পুলিশ। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সব ধরনের যান চলাচল করছে। পরে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

টঙ্গী সংবাদদাতা জানান, গতকাল টঙ্গীতে পুলিশের সামনে তাণ্ডব চালিয়ে শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেছেন পরিবহন শ্রমিকেরা। ভাঙচুরের ছবি তুলতে গিয়ে সাংবাদিকেরা নাজেহাল হয়েছেন। গাজীপুরের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক প্রথম প্রতিরোধের ক্যামেরাম্যান কামাল হোসেনের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেন শ্রমিকেরা।

গাজীপুর জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিকেরা দিনভর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী বাজার বাসস্ট্যান্ড, বাটা গেট, টেশিস গেট, স্টেশন রোড বাসস্ট্যান্ড, মিলগেট বাসস্ট্যান্ড, চেরাগআলী ট্রাক টার্মিনাল, এরশাদ নগর, তারগাছ, বড়বাড়ি, বোর্ডবাজার, ভোগড়া বাইপাস মোড় ও চান্দনা চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে রাস্তায় টায়ারে আগুন দেন। এ সময় শ্রমিকেরা দফায় দফায় বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, ওষুধবাহী গাড়ি ও রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সসহ সব ধরনের যানবাহনে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। তাণ্ডব চলাকালে কোনো কোনো পয়েন্টে পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। চেরাগআলী এলাকায় পুলিশের সামনেই গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি পরিবহনে লুটপাট চালান শ্রমিকেরা। এ সময় পরিবহন চালক ও যাত্রীদের মোবাইল সেট ও টাকা লুটে নেন শ্রমিকেরা। লুটপাট থেকে রেহাই পাননি অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও রোগীর স্বজনেরাও।

চেরাগআলী এলাকায় জরুরি রফতানি কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পোশাক কারখানার বেশ কয়েকটি গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করেন শ্রমিকেরা। এ সময় চালকসহ গাড়িতে থাকা লোকজনকে নামিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। চেরাগআলী ট্রাক টার্মিনাল থেকে টঙ্গীবাজার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রিকশা ও মোটরসাইকেলসহ কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেয়া হয়নি। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও পরীার্থীদেরও রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়। গাড়ির অভাবে গন্তব্যে হেঁটে চলা লোকজনও হামলা ও লুটপাটের শিকার হন। মোবাইলে ছবি তোলার দায়ে পথচারীদের মোবাইল সেট ছিনিয়ে নেন পরিবহন শ্রমিকেরা। পুলিশ রাস্তায় যান ও জননিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে সকালে গাজীপুরা এলাকায় মহাসড়কে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে সব ধরনের যানবাহন আটকে দেয়। ফলে ব্যস্ততম ও যানজটকবলিত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী এলাকা দিনভর ছিল একেবারে ফাঁকা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পরিবহন শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশের রাবার বুলেটে অন্তত ১০ পরিবহন শ্রমিক আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিকেরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গোলচত্বর এলাকায় অবস্থান নিয়ে গাড়ি চলাচলে বাধা দিতে গেলে পুলিশ পরিবহন শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। এ সময় পুলিশ প্রায় অর্ধশত রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে ১০ পরিবহন শ্রমিক আহত হন।

সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড় থেকে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত কয়েকটি পয়েন্টে টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন গণপরিবহন শ্রমিকেরা। গতকাল ভোরে থেকে দুপুরে পর্যন্ত কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে এবং শিমরাইল মোড়, মৌচাক, সানারপাড় ও সাইনবোর্ড মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে লাঠি নিয়ে অবস্থান নেন তারা। এ সময় শিমরাইল মোড় থেকে সানইবোর্ড পর্যন্ত কয়েকটি পয়েন্টে টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে রেখে বিক্ষোভ করা হয়। এ সময় পুলিশের সাথে শ্রমিকদের কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। শ্রমিকেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে মারেন। এ সময় পুলিশও শ্রমিকদের লাঠিপেটা করে। শ্রমিকেরা অ্যাম্বুলেন্স চলাচলেও বাধা দেন। অবরোধ চলাকালে শ্রমিকেরা রিকশাভ্যানের চাকার হাওয়া ছেড়ে দেন। তবে দুপুরের পর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীমিত আকারে পরিবহন চলাচল শুরু হয়।

জাতীয় ডিজিটাল সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের না’গঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি জসিম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জানান, কেন্দ্রীয় নির্দেশে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালন করেন। দুপুরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসে শ্রমিকদের শান্ত করেন।

রাজশাহী ব্যুরো জানায়, পরিবহন ধর্মঘটের নামে সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন শ্রমিকেরা। সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে লাঠি হাতে নিয়ে সিএনজি অটোরিকশার চালকদের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়।

পরিবহন শ্রমিকদের হামলার মধ্যে পড়ে দুপুর সোয়া ১২টায় নগরীর তালাইমারী এলাকায় মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান রুবেল গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তালাইমারীতে শ্রমিকদের ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন বলে প্রত্যদর্শীরা জানান।

নগরীর রেলগেট স্টেডিয়াম এলাকায় পরিবহন শ্রমিকেরা রাস্তা অবরোধ করে অটোরিকশা এবং সিএনজিচালকদের মারধর করতে থাকেন। এ সময় কয়েকটি যানবাহনও ভাঙচুর করেন তারা। এ ছাড়া নগরীর নওদাপাড়া আমচত্বর, শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকাতেও লাঠি নিয়ে বিভিন্ন যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন পরিবহন শ্রমিকেরা। এতে গোটা নগরীতে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/200098