২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:৪৭

পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বুকে ধু ধু বালুচর

প্রকৌশলী এস এম ফজলে আলী

নদীমাতৃক বাংলাদেশকে নদী-নালা-খাল-বিল জালের মতো জড়িয়ে ছিল। সারা বছর নদীগুলোতে পানি থাকত প্রচুর। তাতে সারা বছর নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, নির্বিঘেœ যাতায়াত করত। নৌ-চলাচল করত ২,৫৫০ কিলোমিটার নদীতে। আজ তা সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটারে। তদুপরি, শুকনো মওসুমে অনেক নদীতে পানির অভাবে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতো প্রমত্তা নদীগুলোতেও শুষ্ক মওসুমে পানি থাকে খুব কম। নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে হেমন্ত শেষ না হতেই আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শত শত কার্গো করে সার ও ডিজেল উত্তরবঙ্গে পাঠানোর জন্য যাত্রা করে বাঘাবাড়ী বন্দরে পৌঁছতো। নাব্যতার অভাবে যমুনা নদী দিয়ে কার্গো চলাচল করতে পারছে না। ফলে সার ও ডিজেল পাঠানোতে সাঙ্ঘাতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইরি-বোরো চাষের মওসুম আসন্ন। লরিতে ও ট্রাকে করে সার-ডিজেল চট্টগ্রাম থেকে উত্তরবঙ্গে পাঠাতে হবে। তখন পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাবে এবং বোরো চাষ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। সার ও ডিজেলের অতিরিক্ত পরিবহন খরচ কৃষকদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর ৫৩টিতেই বাঁধ দিয়ে সমানে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। তাই ভাটির বাংলাদেশে পানির সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। নদী-নালা-খাল-বিলে পানির স্তর এত নিচে নেমে গেছে যে, ইরি-বোরো চাষের প্রধান ক্ষেত্র উত্তরাঞ্চলে আজ গভীর নলকূপেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার বুকে ধু ধু বালুচর জেগে উঠেছে। তাতে চাষিরা শাকসবজি ভুট্টা ও গমের আবাদ করছে। এতে সাময়িক লাভ হলেও ভবিষ্যতে যে পুরো দেশটা মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে, তখন তাদের কী হবে?

গঙ্গা নদীর উৎস থেকে শুরু করে মাঝপথে বেশির ভাগ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ফারাক্কা পয়েন্টে পৌঁছতে পারছে না। ভারত গঙ্গার উজানে ৩৬টি উপনদীতে ড্যাম দিয়ে পানি তুলে নিচ্ছে আগে থেকেই। পত্রিকায় প্রকাশ, ভারত গঙ্গায় আরো ১৬টি ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা করছে। তা হলে ভবিষ্যতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিই থাকবে না। তখন বাংলাদেশকে পানি দেয়ার কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না ভারতের। কারণ ভারত-বাংলাদেশ পানি চুক্তিতে ফারাক্কা পয়েন্টের পানির ভাগাভাগির কথা বলা হয়েছে। সে পয়েন্টে পানি না থাকলে ভারত বাংলাদেশকে পানি দিতে বাধ্য নয়। তা হলে শেখ হাসিনা সরকারের ৩০ বছরের গঙ্গা পানি চুক্তির কোনো মূল্যই থাকবে না। ১০ বছর ধরে ভারত আমাদের প্রাপ্য পানির এক-তৃতীয়াংশও দিচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তম পানি সেচপ্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে, জীব-বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন মিঠাপানির অভাবে হুমকির মুখে। মাছ মরে যাচ্ছে, বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পদ্মার শাখা-প্রশাখা মাথাভাঙ্গা, কুমার, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, পশুর, কপোতাক্ষ, মহানন্দাসহ ৩৬টি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পদ্মার বুকে জেগে উঠছে বিশাল বিশাল চর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও চাষাবাদ। ব্যাহত হচ্ছে নৌ-যোগাযোগব্যস্থা। নদীগুলোর তলায় বালু ও পলি জমে খাড়ি কমে যাচ্ছে। পরিণামে বর্ষাকালে অতি পানিপ্রবাহে নদীর ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্ষাকালে বন্যা নিত্যনৈত্তিক ব্যাপার। বৃহৎ তিন নদী দিয়ে উজান থেকে বর্ষাকালে ৩৬ বিলিয়ন টন বালু-নুড়ি ও পলি বাংলাদেশে ঢোকে।

এর বেশির ভাগ তলায় জমে নদী মরে যাচ্ছে। অথচ নদীতে স্রোত থাকলে এই বালু ও পলিমাটি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পৌঁছতে পারলে অনেক নতুন ভূমি জেগে উঠতে পারত। কারণ মোহনায় নদীর পানি পড়লে তার স্রোত কমে যাবে। ফলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে নতুনভাবে জমি পুনরুদ্ধার করা যেত। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নেদারল্যান্ডের মতো আমরা সমুদ্র থেকে জমি পুনরুদ্ধার করতে পারি। কারো কারো মতে, বর্তমান বাংলাদেশের সমপরিমাণ জমি উদ্ধার করতে মাত্র ৫৫ বছর লাগতে পারে। এটি সম্ভব যখন দেশে প্রবাহিত নদীগুলোতে সারা বছর স্রোতের পরিমাণ বেশি থাকে। বর্তমানে হাতিয়া-সন্দ্বীপ এলাকায় প্রাকৃতিকভাবেই চর জেগে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত হচ্ছে। ভূমি উদ্ধারপ্রযুক্তি খাটিয়ে এ জমি উদ্ধারপ্রক্রিয়া দ্রুত করা যায়।

আমাদের বৃহত্তম ব্যারাজ তিস্তা নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়ার প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে পানি সেচের জন্য। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের একটি অনন্য অর্জন। এর প্লান, ডিজাইন ও নির্মাণ দেশের প্রকৌশলীরাই করেছেন। এতে কোনো বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রকৌশলীরা তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করেছেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছিল, তা নস্যাৎ করে দিচ্ছে ভারত। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে জলপাইগুড়ির গজলডোবার বাঁধসহ আরো অনেকগুলো বাঁধ দেয়ায়, বলতে গেলে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে এখন পানিই নেই। তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ১,৫০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচের সব ব্যবস্থা থাকলেও পানির অভাবে তা এখন অকার্যকর। ভারত তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি করার কথা দুই যুগ থেকে বলে আসলেও তা করছে না। বরং তিস্তা নদীর অববাহিকার পানি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের কাছে ৫০০ কিউসেক পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতেই প্রয়োজন ৫০০০ কিউসেক পানি। সেচের জন্য শুষ্ক মওসুমে আরো প্রয়োজন ১০ হাজার কিউসেক। ভারতের কংগ্রেস সরকার তিস্তার পানি চুক্তির প্রটোকল করেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভেটোতে তা কার্যকর হচ্ছে না।

তিস্তার পানি না থাকলে উত্তরবঙ্গ পানিশূন্য হয়ে পড়বে। তাতে কৃষিকাজ বিপন্ন হবে। মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশে। তাহলে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান কোথা থেকে হবে?

ভারত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে টিপাইমুখ ড্যাম করা শুরু করেছে। বলা হচ্ছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ প্রকল্প। কিন্তু টিপাইমুখ থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে চোরামন নামক স্থানে ড্যাম করে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে করে আমাদের কুশিয়ারা ও সুরমা নদীতে তেমন পানি পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশকে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারার সব ব্যবস্থাই গুটিয়ে আনছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র।

আমাদের বাঁচার উপায় কী? ভারত কোনো দিনই দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের সাথে পানি সমস্যার সমাধান করবে বলে মনে হয় না। তাদের কাছ থেকে পানি আদায় করার পথ ধরতে হবে। পানি আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। সারা বিশ্বে আজ একটা কথা চাউর হয়ে গেছে, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে, তা হবে পানি সমস্যা নিয়ে। সে কথা মাথায় রেখে এখনি বাংলাদেশ-ভারত পানি সমস্যার সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়টি তুলতে হবে জোরালোভাবে। জাতিসঙ্ঘে তুলতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অভিন্ন নদীর পানি কোনো একটি দেশ এককভাবে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। ভাটি অঞ্চলের দেশকে বঞ্চিত করে শুধু নিজের স্বার্থ দেখাকে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি দেয় না। বিশ্বে এর বিশ্ব উদাহরণ আছে। প্রতিবেশী দেশগুলো অভিন্ন নদীর পানি সমতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছে। ইউরোপের দানিয়ুব নদী ১২টি দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে দানিয়ুব নদীর পানি ব্যবহার করছে। নীল নদের পানি মিসর, ইথিওপিয়া ও সুদান ব্যবহার করছে। হোয়াংহো নদীর পানি, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ব্যবহার করছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বৈরিতা থাকলেও সিন্ধু নদের পানি সমতার ভিত্তিতে ব্যবহার করছে। ব্যতিক্রম শুধু ভারতের ব্যাপারে। তারা আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি সমানে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভাটির বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার বিষয় ভারত আমলই দিচ্ছে না।

আমাদের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের নদীগুলোর তথ্য-উপাত্ত, ম্যাপ, বেসিন এরিয়া ইত্যাদি বিষয়ের তথ্যাদিসহ আমাদেরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাবি তুলতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জাতীয় ঐক্য না হলে কোনো দাবিই আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পাবে না। আমাদের সেই ঐক্যের বড়ই অভাব। রাজনীতির ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। গদি দখল ও ধরে রাখার লড়াই চলছে। তাতে জাতীয় স্বার্থ নষ্ট হলেও যেন মাথা ব্যথা নেই। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। আজ আমাদের দরকার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। ১৯৭৬ সালে তার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ফারাক্কা মার্চ লৌহমানবী ইন্দিরা গান্ধীকেও ফারাক্কা চুক্তি করতে বাধ্য করেছিল।

এই অঞ্চলের পানিসম্পদের সঠিক ব্যবহারের জন্য চীন-ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভারত কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে চীন তিব্বতের সাংপো নদীতে ড্যাম করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য, ৮০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মরু অঞ্চলে পানি সরবরাহ করে তার কৃষির সম্প্রসারণ করা। এটি চীন এককভাবে কার্যকর করলে ওই ড্যামের ভাটিতে আর পানি তেমন পাওয়া যাবে না। ভারতের আন্তঃনদী মহাপ্রকল্প তখন পণ্ড হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ও চীনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ভারতের এ অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধান করতে হবে। চীন ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে সীমানা নিয়ে প্রবল বিরোধ রয়েছে। তাই বাংলাদেশ এখানে মধ্যস্থতা করতে পারে। এ জন্য আমাদের পররাষ্ট্রনীতির যেমন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে, তেমনি উপযুক্ত লোক দ্বারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চালাতে হবে। চীনকে বুঝিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হিমালয় অঞ্চলসহ বৃহৎ নদীগুলোর অববাহিকার পানির হিস্যা নির্ধারণ করতে হবে।

আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের পানি সমস্যার কথা জানাতে হবে। আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় বড় নদীগুলোর যাতে নাব্যতা বজায় থাকে সে জন্য শক্তিশালী ড্রেজিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সত্তরের দশক থেকে গঙ্গা বাঁধের কথা আলোচনা হয়ে আসছে। কিন্তু কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তা আজো অগ্রসর হয়নি। গঙ্গা বাঁধ আমাদের বাঁচা-মরার ব্যাপার। বাস্তবায়নের তৎপরতা চালানো জরুরি। নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ের পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। পানিশূন্য বাংলাদেশ মানে মরুভূমি। তাই নিজস্ব প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় পানি জোগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/200025