১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১:৩১

মেধাবীদের স্বপ্নভঙ্গ সরকারি কলেজে

সরকারি কলেজে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে মেধাবীদের। প্রায় সব সুবিধা থাকার পরও নানা কারণে এইচএসসিতে প্রত্যাশিত ফল মিলছে না। জিপিএ-৫ নিয়ে যারা এসব কলেজে ভর্তি হচ্ছেন তাদের ৬৪ শতাংশই হোঁচট খাচ্ছে এইচএসসিতে। মানসম্মত শিক্ষক, ক্লাস রুমসহ আনুষঙ্গিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও পাসের মুখ না দেখা শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও কম নয় বরং অন্যান্য কলেজের তুলনায় বেশি। ফলে দিন দিন সরকারি কলেজের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। মাউশির প্রতিবেদনে এ জন্য শিক্ষকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, কোচিং মানসিকতা, নোট-গাইডমুখী লেখাপড়াকে দায়ী করা হয়েছে। মাউশির এই প্রতিবেদনের সঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষরাও সহমত পোষণ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারি কলেজে শিক্ষার মানের ব্যাপারে আমরাও সন্তুষ্ট নই। এ কারণে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে এসব কলেজের ফলাফল কেমন, পাঠদানের ধরনই বা কী, শিক্ষকদের সংখ্যাসহ বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়নে অধ্যক্ষদের ডেকে কর্মশালা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এর বাইরে বেশ কিছু নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। হাতে আসা তথ্যও বিশ্লেষণ করে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

মাউশির হিসাবে সারা দেশে ৩২৭টি সরকারি কলেজ রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকে এগুলোর ২৯৪টিতে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৭১টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয় ২ লাখ ১৭ হাজার ৯১৮ জন। বাকি ৩৪ হাজার ২৭০ আসনই ছিল খালি, যা প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ সরকারি সব সুবিধা নিয়ে এসব কলেজ চলছে। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত মেধাবী দক্ষ-প্রশিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকরাই পাঠদান করছেন এসব কলেজে।

প্রত্যাশিত ফলাফল না করায় এসব কলেজের প্রতি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আগ্রহও কম। ফলে প্রতি বছরই বহু আসন খালি যাচ্ছে এসব কলেজে। মাউশির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ২ হাজার ১১৫টি আসনের বিপরীতে অর্ধেকের বেশি আসনই খালি ছিল এবং এই সংখ্যা এক হাজার ২০৮টি। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসায় এক হাজার আসনের মধ্যে ৮৩৯টিই খালি। ভোলার শাহবাজপুর কলেজে ৯৫০ আসনের মধ্যে ৬৩৬টিই খালি। এভাবে খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজে ১৩৭৫ আসনের মধ্যে ৬২৬টি, নওগাঁর সাপাহার মহিলা কলেজে ৯শ’ আসনের ৫৮৪টি, ফেনীর ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে এক হাজার ৯০০ আসনের মধ্যে ৫৬৪টি, পটুয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজে ১৫০০টির মধ্যে ৪৯৩টি, সাতক্ষীরার তালা সরকারি কলেজে ৬০০ আসনের ৪৬০টি এবং খুলনা সরকারি কলেজে ৬১০টির মধ্যে ৪৫৩টিই খালি আছে। তবে কোথাও উল্টো চিত্রও আবার রয়েছে। ১৬টি সরকারি কলেজে আসনের চেয়ে বেশি ভর্তির চিত্রও মাউশির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষার যে কী দৈন্যদশা তা ফলাফলের চিত্র দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। যেমন গত বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া সরকারি কলেজের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ২৭ শতাংশ ফেল করেছে। অথচ গড় ফেলের হার ছিল ২৫ শতাংশেরও কম। মাউশির এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পাস করা মেধাবীরা যেসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করছেন সেখানেই যদি শিক্ষার এই হাল হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠাই তো স্বাভাবিক।

মাউশির প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া ৩৯ হাজার ৭২৮ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে এসব সরকারি কলেজে। এর মধ্যে গত বছর এইচএসসিতে মাত্র ১৪ হাজার ১৯৯ জন জিপিএ-৫ ধরে রাখতে পেরেছে। অর্থাৎ তাদের ৬৪ শতাংশই এসএসসির ফল ধরে রাখতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জের আদমজীনগর এমডব্লিউ সরকারি কলেজে ৯৪৪ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। কিন্তু গেল বছর এইচএসসিতে তাদের মধ্যে মাত্র ১৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এক হাজার ৮ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৭৪ জনই আগের রেজাল্ট ধরে রাখতে পারেনি। কক্সবাজার সরকারি কলেজে ৫৪৮ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৬০ জন আগের ফল ধরে রাখতে পেরেছেন। ঢাকা কলেজেও ভালো ছাত্রদের খারাপ করার চিত্র দেখা গেছে। এ কলেজে ৮৮৮ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও গত বছর এইচএসসিতে ৫৯৯ জন আগের ফল ধরে রাখতে পেরেছে। তবে নয়টি সরকারি কলেজের চিত্র বেশ ভালো। এর মধ্যে খুলনার বঙ্গবন্ধু কলেজে ৮৯ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। কিন্তু ওই ব্যাচে ৩৩২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে এইচএসসিতে। ভালো করা সরকারি কলেজের মধ্যে উত্তরার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি মহাবিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু কলেজ, ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ অন্যতম।

মাউশির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শুধু এইচএসসিই নয়, স্নাতক-অনার্স-মাস্টার্সের ফলের ক্ষেত্রেও সরকারি কলেজগুলোতে একই ধরনের দৈন্যদশা বিরাজ করছে। মানিকগঞ্জের সরকারি মহিলা কলেজে গেল বছর এ ধরনের বিভিন্ন পরীক্ষায় ৮১২ জন অংশ নেয়। এদের একজনও সিজিপিএ-৩ পাননি। গ্রেডিং সিস্টেমে সিজিপিএ-৩ ফলকে প্রথম শ্রেণী ধরা হয়। এমনই আরও অনেক কলেজের দৈন্যদশা উঠে এসেছে মাউশির প্রতিবেদনে।

তবে ভিন্ন কথা বলছেন সরকারি কলেজর শিক্ষকরা। তারা বলছেন, অন্যান্য কলেজে ভালো ফল করার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। শিক্ষকরা নিজেরাই শিক্ষার্থীদের নকলে উৎসাহিত করে। ইনকোর্স, টার্ম পেপার, ভাইভাসহ অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় উদারভাবে পরীক্ষার্থীদের নম্বর দেয়ার অভিযোগ আছে। তবে নাম প্রকাশ না করে একাধিক কলেজ অধ্যক্ষ এই প্রতিবেদককে বলেছেন, এভাবে যদি ছাত্রছাত্রীদের খারাপ ফলের রেকর্ড তৈরি হয়, তাহলে শিক্ষার পরিস্থিতি যে কতটা উদ্বেগজনক তা সহজেই অনুমেয়।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আলমগীর বলেন, রোববার অধ্যক্ষ সম্মেলনে কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নে ৩৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো অনেকটাই আত্মসমালোচনামূলক। আমরা তাদের বলে দিয়েছি, শিক্ষার্থী থাকাকালে আপনারা কলেজের কাছে যা প্রত্যাশা করেছিলেন, এখন শিক্ষার্থীদের তাই দেবেন। তাহলেই শিক্ষায় মানের সমস্যা দূর হবে। মাউশি মহাপরিচালক যুগান্তরকে বলেন, কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা তা ফলোআপ করব। এছাড়া মডেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম সবাইকে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে দেখানো হয়েছে। সবাই সচেতন মানুষ। আশা করছি, এখন ভালো কিছুই জাতি পাবে।