১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার

আমীরে জামায়াতের সঙ্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত

-ডা. শফিকুর রহমান

আজ ১৬ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। আমীরে জামায়াতের সঙ্গে ছিলেন নায়েবে আমীর, সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, এবং আমীরে জামায়াতের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন—
দলের সভাপতি মুনির সাতৌরী, লুক্সেমবার্গের (ইপিপি) ইসাবেলা ভিয়েডার-লিমা, পোল্যান্ডের (ইসিআর) আরকাদিউস মুলারচিক, এস্তোনিয়ার (রিনিউ ইউরোপ) উর্মাস পায়েট, নেদারল্যান্ডসের (দ্য গ্রিন্স) কাতারিনা ভিয়েইরা—সহ আরও অনেকে।

বৈঠক শেষে এক সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের বলেন, “আমাদের সঙ্গে তাদের খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে—নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা, কীভাবে হবে—এসব বিষয়েই মূলত তারা জানতে চেয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে ৫৪ বছর পরে একটি পরিবর্তনের বিশেষ সুযোগ (opportunity) এসেছে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার ব্যাপারে আন্তরিক এবং সচেতন। এই সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—তারা সংস্কার করবে, বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনবে এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে—এগুলোই আমরা ‘ফ্রি ও ফেয়ার’ নির্বাচন হিসেবে দেখতে চাই।”

“আপনারা জানেন, সরকার একটি এনসিসি (জাতীয় কনসেনসাস কমিটি) গঠন করেছিল। সেখানে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছি। বাংলাদেশে এসব বিষয়ে একটি ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে—যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে কিছু মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।"

"আপনারা জানেন, আমরা ৩১টি দল আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম, যার মধ্যে ২৬টি দল ‘পিআর’-এর (PR - Proportional Representation) পক্ষে ছিল। ইসলামপন্থী, ডানপন্থী ও বামপন্থী দল—সব মিলিয়ে। কিন্তু সেখানে পার্থক্য ছিল এই যে—কিছু দল ‘আপার হাউজে’ (উচ্চ কক্ষ) পিআর চাচ্ছে, আবার কিছু দল ‘আপার’ ও ‘লোয়ার’ দুই কক্ষেই পিআর চায়। আমরা জামায়াতে ইসলামী, উভয় কক্ষে পিআর চাই।”

“এই দাবির পেছনে আমাদের দুটি যুক্তি রয়েছে—
১. গত ৫৪ বছরে প্রচলিত (ট্র্যাডিশনাল) পদ্ধতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।
২. গত ১৫ বছরের তিনটি নির্বাচন নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই, সেগুলো নিজেরাই যথেষ্ট প্রমাণ।”

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর যেই কালচার—জোর করে কেন্দ্র দখল করে এমপি হওয়া, ক্ষমতায় যাওয়া—এই মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। এত অভিজ্ঞতা, এত প্রাণহানি, এত রক্তের পরেও আমরা মানসিকতার পরিবর্তন দেখছি না। এর বড় উদাহরণ হলো—ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচন। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছে, তারপর হেরে যাবে বুঝে নির্বাচন বর্জন করেছে। বলেছে, নির্বাচন মানি না। এর মানে, তারা ফেয়ার ইলেকশন পছন্দ করে না।"

“জাকসুর ক্ষেত্রে দেখা গেছে—৭২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ফল ঘোষণা দেয়নি। সবার চোখের সামনে ছিল বলেই ফল উল্টাতে পারেনি। কিন্তু মানসিকতা তো রয়ে গেছে—ফল উল্টে দেওয়ার। জাতীয় নির্বাচনেও এমন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

“তাই আমরা বলেছি—পিআর সিস্টেম হলে এককভাবে কোনো প্রার্থী কোনো এলাকায় দাঁড়াবে না এবং কেন্দ্র দখলের আগ্রহ হারাবে। এজন্য অন্তত একবার পরীক্ষামূলকভাবে পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চাই। ভালো না হলে, পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন করা যাবে।”

“আমরা পিআর চাই—উভয় কক্ষে। অধিকাংশ মানুষ পিআরের পক্ষে। ইউরোপের প্রতিনিধিরাও বলেছেন—তাদের দেশেও পিআর সিস্টেম রয়েছে। তারা আমাদের কথা সহজেই বুঝতে পেরেছেন।”

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মেয়াদ বাড়ালেই যে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে—তা আমি মনে করি না। ঐকমত্যে পৌঁছাতে এক ঘণ্টাও যথেষ্ট। তারপরেও সময় বাড়ানো হয়েছে। এর দুটি কারণ হতে পারে—একটি, আন্তরিকভাবে আরও কিছু বের হয় কিনা তা দেখা। কিন্তু আমি সন্দেহ করি—এটা সময় নষ্ট করার কৌশল। এখন মানুষের মধ্যেও এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই দুই-তিন মাস ধরে কনসেনসাস কমিটির সঙ্গে কাজ করছি। আমরা ঐকমত্যেও পৌঁছেছি। এটিকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এখন কেবল একটি সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা দেখছি—এক মাস ঘুরে ফিরে আবার এক মাস পিছিয়ে গেছি, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। এর ফলে আরও একটি মূল্যবান মাস চলে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা বলিনি যে নির্বাচনে যাব না। আমরা বলছি, পিআর পদ্ধতিটাই উত্তম এবং সেটিই দাবি করছি। আমরা যুক্তি দিচ্ছি, বোঝানোর চেষ্টা করছি এবং আশা করছি—তারা আমাদের যুক্তি মেনে নেবে। সেই ভিত্তিতেই আমরা নির্বাচনে যাব।”

“আমরা উচ্চ এবং নিম্ন উভয় কক্ষে পিআর চাই। আলোচনা টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা আলোচনায় যেতে চাই, আলোচনা করতে চাই। তবে এজন্য উদার এবং নিরপেক্ষ মানসিকতা প্রয়োজন।”