জামায়াতের ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বলেছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘ, ওআইসি ও সার্কের মতো বিভিন্ন সংস্থার কাছে ভারত কর্তৃক নির্মিত টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষতিকর দিকসমূহ তুলে ধরার সুযোগ থাকলেও আমাদের সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার দেশের জনগণকে ঘুম পাড়ানির প্রক্রিয়ায় রেখে প্রকৃত পক্ষে তারা ভারতের অপতৎপরতা আড়াল করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, যেসব পত্রিকা ও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের মানুষ তাদের নিজেদেরই আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি শুনতে পায় সরকার সেসব পত্রিকা বন্ধ করে দিচ্ছে। আর রাজনৈতিক দলকেও সভাসমাবেশ করতে বাকশালী কায়দায় বাধা দিচ্ছে। তবে তিনি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এদেশের জনগণর নিজেদের অধিকার আদায়ে ১৪৪ ধারা কেন প্রয়োজনে কারফিউকে ভয় করবে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর জামায়াতের কার্যালয় চত্ত্বরে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঢাকা মহানগর জামায়াত আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমীর রফিকুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, এটিএম আজহারুল ইসলাম, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশেনের সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বুলবুল, মাওলানা আব্দুল হালিম, মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য ডা. রেদওয়ানুল্লাহ শাহেদী প্রমুখ।
জনাব মুজাহিদ বলেন, যারা আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার এবং যারা অন্য কোন দেশের তাঁবেদারি পছন্দ করে না সরকার তাদের কণ্ঠরোধ করতেই অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার চায় না দেশের মানুষ সচেতন হোক।
তিনি বলেন, আমরা জামায়াতের ইসলামীর পক্ষ থেকে গত ৩১ মে পল্টনে জনসভা করে দেশের মানুষকে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সচেতন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সমাবেশ করতে সরকার বাধা দিয়েছে। সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, গত বছর ২০ মে আমরা পল্টন ময়দানে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছি। সেখান থেকেই আমরা দেশবাসীকে সাথে নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। এর পর সিলেটে গিয়েও জামায়াতের পক্ষ থেকে আমরা নৌমার্চও করেছি। জামায়াতের পক্ষ থেকে আমরা সর্ব প্রথম বলিষ্ঠভাবে বলতে চেষ্টা করেছি যে, ভারত যদি টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করে তাহলে বাংলাদেশে এর ক্ষয়ক্ষতি হবে পারমাণবিক বোমা বিফোরণের চাইতে বেশি ভয়াবহ। কিন্তু দুঃখজনক হলো চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে যেসব সুশীল সমাজ পান থেকে চুন খসলেই আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলতো এখন তাদের পক্ষ থেকেই টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়ে কোন প্রতিবাদ পাওয়া গেল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গোটা জাতিকেই যেন ঘুম পাড়ানোর প্রক্রিয়াতে রাখা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কোন প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে নির্মাণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও ভারত সরকারের সাথে চুক্তিও সম্পাদিত হয়ে গেছে। এম সময় আসবে যখন বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো আমন্ত্রণও জানানো হতে পারে। তখন এই সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বলা হবে আমাদের অন্তত যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সম্মানও দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়লে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা ছিল। এই বাঁধের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে লবিং করারও অনেক সুযোগ ছিল। কিন্তু তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে আমাদের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ২২টি নদী শুকিয়ে যাবে। দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। লোনা পানি সমুদ্রের উপরিভাগে চলে আসবে। আমাদের কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্যসহ অনেক বেশি ক্ষতি হবে। নাব্য হ্রাস পাবে। বড় ধরনের ভূমিকম্পেরও আশংকা করছেন বিশেজ্ঞরা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় সার্বিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করছে না। বরং ভারতের অপতৎপরতা আড়াল করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বেই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে দেশের উত্তরাঞ্চলকে প্রায় মরুভূমিতে পরিণত করছে। অথচ সরকার সেদিকে কর্ণপাত করছে না।
গত বছরের ২০ মে'র পল্টনের জনসভা এবং জামায়াতের বক্তব্যকে আমলে নিয়ে সরকার পরে একটি সংসদীয় দলকে টিপাইমুখ পরিদর্শনে ভারত পাঠিয়েছিল। কিন্তু সংসদীয় দল সেখানে টিপাইমুখ বাঁধের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি বলে জাতিকে জানানো হয়েছে। এর পর প্রধানমন্ত্রী নিজে ভারত সফর করে দেশে ফিরে জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু ভারত করবে না বলে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সরকারের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে। প্রধান অতিথি আরো বলেন, সরকার ব্যর্থ হলে জনগণকেই দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বজনমতসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে দাবি দাওয়া জানাতে হবে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার ইতোমধ্যেই প্রচার মাধ্যমগুলো বন্ধ করতে শুরু করেছে। এ অবস্থা সেই ৭৫ পূর্ববর্তী বাকশালী শাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তারা দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিনষ্টে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, কোন অবস্থাতেই এ সরকারের ষড়যন্ত্র সফল হবে না। ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটানো হবে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান বলেন, ভারতকর্তৃক উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু সরকার বিষয়টি নিয়ে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। সরকার দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ পর্যন্ত ভারতের সাথে যে কয়টি চুক্তি বা যৌথ ইশতিহার সম্পাদিত হয়েছে তা সব কয়টি ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে। আওয়ামী সরকারের আমলে মাত্র ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাধ চালু করলেও এখন পর্যন্ত ৪১ দিনই শেষ হয়নি। ৩০ বছরের পানি চুক্তি করলেও আমরা ন্যায্য হিস্যা পায়নি।
আব্দুল কাদের মোল্লা বলেন, জনগণের ভোটে বা স্বাভাবিক পন্থায় এ সরকার ক্ষমতাসীন হয়নি। তাই এ সরকারের বিদায়ও স্বাভাবিকভাবে হবে না। দুর্বার গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা পালানোর পথ না পায়। এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, মূলত বর্তমান সরকার তল্পীবাহক ও তাঁবেদার সরকার। এরা গণতন্ত্র হত্যার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে গণদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। ভারত কর্তৃক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হলে এ সরকারের পতনের কোন বিকল্প নেই। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ফারাক্কার আদলেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ চলছে। এটা রোধ করা সরকারেরই দায়িত্ব কিন্তু তারা তা করছে না। তাই গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ রোধ করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বর্তমান সরকার তাঁবেদার সরকার। এরা জনগণের কাছে নয় ভারতের কাছে দায়বদ্ধ। যারা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে কথা বলে না তারা জনগণের বন্ধু বা দেশপ্রেমিক নয়। মূলত এ সরকার তাঁবেদার দালাল ও স্বৈরাচারী সরকার। তারা ১৪৪ ধারা জারি করে নিজেদেরকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে জনগণের কণ্ঠরোধ করা যাবে না । দেশে ইসলামী রাজনীতি বন্ধের অপচেষ্টা করা হলে জনগণ বসে থাকবে না বরং ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
কার্টেসীঃ দৈনিক সংগ্রাম