১৮ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার

সারাদেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের দাবিসমূহ বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে তার যৌক্তিক সমাধান করার আহ্বান- অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে দেশের ছাত্রসমাজের চলমান আন্দোলনের উপর সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের সশস্ত্র হামলায় ৭ জনের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী আহত হওয়া এবং দেশব্যাপী সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আহুত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বক্তব্য রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম প্রমুখ।

দেশবাসীর উদ্দেশে সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার-এর প্রদত্ত বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ-
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ ও সংগ্রামী দেশবাসী,

আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

আমরা অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমগ্র বাংলাদেশ আজ রক্তে রঞ্জিত। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের শিক্ষাজীবন আজ অনিশ্চয়তার মাঝে উপনীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্ররা হল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আজ আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি।

আপনারা সকলেই জানেন, বেশ কিছুদিন যাবত সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে দেশের ছাত্রসমাজ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার প্রথম থেকেই ছাত্রসমাজের আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আসছে। দেশের শিক্ষক সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, ওলামায়ে কেরামসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহ ছাত্রসমাজের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়ায় ছাত্রসমাজের আন্দোলন একটি সিদ্ধান্তকারী পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার ছাত্রসমাজের আন্দোলনের যৌক্তিক সমাধান না করে সংবিধান ও আইন আদালতের দোহাই দিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজকে “রাজাকারের নাতি-পুতি” আখ্যা দিয়ে কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির অফিসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, “আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।” পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের পিতা-মাতাকে কটাক্ষ করে তাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে উত্তপ্ত করেছেন।


প্রিয় দেশবাসী ও সাংবাদিক বন্ধুগণ,
প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদের উস্কানীমূলক বক্তব্যের পর সারাদেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত ১৬ জুলাই দেশব্যাপী আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ ও বহিরাগত আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র, হকিস্টিক, ছোড়া, রামদা, লোহার রডসহ নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলা চালিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত ৫ জন যুবককে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা গিয়েছে (প্রথম আলো: ১৬/৭/২০২৪)। চট্টগ্রামের স্বেচ্ছাসেব কলীগ নেতা মো: দেলোয়রের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল এবং নূরুল আজিম রনির নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়েছিল (মানবজমিন: ১৭/৭/২০২৪)। ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হাসানকে পিস্তল দিয়ে হামলা চালাতে দেখা গিয়েছে। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ (যুগান্তর: ১৭/৭/২০২৪)। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত ছবিতে ছাত্রলীগ ও বহিরাগত আওয়ামী সন্ত্রাসীদেরকে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হামলা চালাতে দেখা গিয়েছে এবং অনেককে তারা পিটিয়ে মাটিতে ফেলে পদদলিত করার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীদের উস্কানীর কারণেই গত ১৫ ও ১৬ জুলাই সারাদেশে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার জন্য সরকারই দায়ী।

প্রিয় দেশবাসী,
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে ছাত্রসমাজের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নির্মম আক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেছি। দেশবাসী বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখেছেন রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ও বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ সারাদেশ সাধারণ ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত করেছে। তাদের আক্রমণে ৭টি তরু-তাজা প্রাণ অকালে ঝড়ে পড়েছে। দেশের ছাত্রসমাজের এই রক্ত দান গোটা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং মানবাধিকার সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। মূলত সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের পরেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সুতরাং সরকারের মন্ত্রীগণ এই হত্যাকাণ্ডেরর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

গতকাল সন্ধ্যায় (১৭ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে ছাত্রসমাজের যৌক্তিক দাবি সমাধানের কোনো দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায়নি বরং তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে, প্রকৃত উস্কানিদাতাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমরা বলতে চাই, সরকারের মন্ত্রীদের উস্কানিমূলক বক্তব্য ও দলীয় সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবতার সচিত্র প্রতিবেদন পত্র-পত্রিকা খুঁজলেই বোঝা যাবে হামলাকারী কারা ও উস্কানীদাতা কারা? আমরা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

প্রিয় দেশবাসী,
সরকার আন্দোলনরত ছাত্রসমাজের ওপর হামলার পাশাপাশি তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ছাত্রদেরকে জোর করে হল থেকে বের করে দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, ছাত্রসমাজের দাবির যৌক্তিক সমাধানের মাধ্যমেই বর্তমান সংকটের সমাধান হতে পারে। কিন্তু সরকার তা না করে গোটা ছাত্রসমাজের শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিয়েছেন। সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত জনগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে দেশের বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত আহ্বান জানাচ্ছিঃ

১। ৭ জন ছাত্র হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট খুনিদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের দাবিসমূহ বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে তার যৌক্তিক সমাধান করতে হবে।
৩। অবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষাজীবন রক্ষা করতে হবে।
৪। যারা সশস্ত্র হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে ও হাজার হাজার ছাত্রকে আহত করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫। নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রিয় দেশবাসী,
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে দল-মত-নির্বিশেষে রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে উঠে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সকল ধরনের তাণ্ডবতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বৈষম্যবিরোধী চলমান এই শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনের প্রতি আমরা পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করছি এবং দেশবাসীকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

আল্লাহ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জিন্দাবাদ।

এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে আমার বক্তব্য শোনার জন্য আপনাদের সবাইকে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”