বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর রুকন সম্মেলন’২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর মুহাম্মদ শাহজাহানের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।
শুক্রবার অনুষ্ঠিত এ ভার্চুয়াল সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা'ছুম, দারসুল কুরআন পেশ করেন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম। কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমীনের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী নায়েবে আমীর ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ ও মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম, নগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মাওলানা খাইরুল বাশার, মুহাম্মদ উল্লাহ, এফ এম ইউনুছ ও মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের চট্টগ্রাম মহানগরী সভাপতি এস এম লুৎফর রহমান প্রমুখ।
সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি সবকিছু দূষিত ও কলুষিত হয়ে গেছে, এগুলোকে পরিশুদ্ধ করার জন্য জান ও মাল দিয়ে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সরকারের লুন্ঠন ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য প্রকট। এখানে সম্পদের কোন নিরাপত্তা নেই, ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরীবরা আরো গরীব হচ্ছে। আমরা দুনিয়ার শান্তি পেতে চাই আবার আখিরাতেও কল্যাণ পেতে চাই, অথচ সমাজে সুদ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, এটি সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছে, সুদের ব্যাপারে আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে, এটি মারাত্মক ব্যাধি। একমাত্র যাকাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থাই ধনী-গরীবের বৈষম্য দূর করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বিনিময়ে আমাদের জানমাল কিনে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে আমরা চুক্তিবদ্ধ। আর এই চুক্তির শর্তাবলি যথাযথভাবে পালনের মধ্যেই রয়েছে মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার বিধান ও রাসূল সা.-এর আদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। মানুষের দুনিয়াবী জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী; চিরস্থায়ী আখেরাতের জীবন। তাই দুনিয়ার জীবনের চেয়ে আখেরাতের জীবনকেই আমাদেরকে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। এজন্য দ্বীন বিজয়ের প্রচেষ্টা চালানোর কোনো বিকল্প নেই। আর দ্বীনকে বিজয়ী করতে রুকনদের জান ও মাল দিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ময়দানে নামতে হবে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সাথে। এক্ষেত্রে হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই সকল জুলুম-নির্যাতন ও বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেন, এ শাহাদাতের এতো বছর পরেও শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামবিরোধী বানানোর জন্য বর্তমান সরকার উঠেপড়ে লেগেছে, পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্যকে পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলা হয়েছে, যা একটি জঘন্য কাজ, এর বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের ঈমানের দাবী। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের মানুষের ঈমান আকীদার ভিত্তিতে সরকার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করবে।
তিনি আরো বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে চট্টগ্রাম মহানগরী অতীতেও সাহসী ভূমিকা রেখেছে, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও রাখবে। বর্তমানে চলমান কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমাদেরকে অতীতের মতো ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের শোচনীয় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য আন্দোলন ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোন পথ খোলা নেই।
তিনি বক্তব্যে ভূমিকম্পে পর্যুদস্ত তুরস্কের পাশে দাঁড়াতে জামায়াতের সকল স্তরের জনশক্তির প্রতি আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাসুম বলেন, রাসুল সা. এর নবুয়াতি জিন্দেগীই আমাদের জন্য সর্বোত্তম নমুনা। আমাদেরকে কথার চেয়ে আমলে সত্যের সাক্ষ্য বহন করে যেতে হবে। কাল হাশরের ময়দানে প্রমাণ হবে, জামায়াতে ইসলামী সত্যের জন্য কাজ করেছে, সত্যের জন্য লড়াই করেছে, জনগণই সাক্ষ্য দেবে ইনশাআল্লাহ। যেদিন থেকে আমরা রুকুনিয়াতের শপথ নিয়েছি সেদিন থেকে শাহাদাতের বাস্তব নমুনা হতে পেরেছি কিনা এটা সবসময় উপলব্ধিতে রাখতে হবে, জামায়াতের রুকন মানে কোন ব্যক্তি নয়, একেকটি প্রতিষ্ঠান, একজন রুকন গঠনতন্ত্র মোতাবেক ইসলামী আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে মর্যাদা রাখে, প্রতিটি মুহূর্তে এই অনুভূতি আমাদেরকে লালন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আল্লাহ আমাদেরকে ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যখন যা ইবাদাত আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, তাঁর ব্যাপারে আমাদের কোনরকম গাফিলতি থাকলে চলবে না, শিরকের ব্যাপারে সকলকে সচেতন করতে হবে, সুন্নাহ বিরোধী বিদ’আত থেকে দূরে থাকতে হবে, সালাতের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক হতে হবে, সমাজের সর্বস্তরের লোকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, মুমিন শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে না, তার আশেপাশের মানুষদের নিয়ে ভাববে।
মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, বাহ্যিক বেশভূষার নাম তাকওয়া নয়। যে অন্তর আল্লাহর ভয়ে তটস্থ থাকে, খারাপ কাজে বিরত থাকে, সেটিই তাকওয়া। কেবলমাত্র তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়ই সকল অন্যায় কাজ থেকে আমাদেরকে বিরত রাখতে পারে। তাকওয়ার মডেল হিসেবে তিনি নবী-রাসূল এবং সাহাবীদেরকে অনুসরণ করার উপর জোর তাগিদ প্রদান করে বলেন, আমাদের পথচলা কে আরো দৃঢ় করতে হবে। ইসলামী আন্দোলনে পরাজয় ও পিছুটান বলে কিছু নেই। সত্যের সন্ধান, সত্যকে গ্রহণ, সত্যের উপর দৃঢ় থাকা, আল্লাহ ভীতি, দায়িত্ব সচেতনতা ও দায়িত্বানুভূতি এবং যথাযথভাবে কর্তব্য সম্পাদন এসবই তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, তাকওয়া ও আনুগত্যই আমাদের সম্বল, ইসলামী আন্দোলনের শপথের দাবী হচ্ছে আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় এবং তাঁর আনুগত্য করা। আল্লাহর পরিপূর্ণ গোলাম হিসেবে নিজেকে পেশ করতে হবে। একজন রুকন হিসেবে নিজের সমস্ত দুর্বলতা দূর করে আল্লাহর কাছে তাওবা করে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেন আমরা দ্বীনের পথেই নিজেদের বাকী জীবন কাটাতে পারি। সাংগঠনিক ভাবে আমাদের যার ওপর যে দায়িত্ব আছে, সকল দুনিয়াবি কাজের ওপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের এ কাফেলা আমাদেরকে পরিপূর্ণ মুমিন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পেরেশান, এ কাফেলা আমাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যেতে চায়, অথচ আমরা সংগঠনের হক যথাযথভাবে আদায় করতে পারছি না। এ পথের যত বাঁধা তা পদধলিত করে আমরা এগিয়ে যাব, রুকন সম্মেলন আমাদের মাঝে নতুন করে সেই চেতনা জাগ্রত করুক।
তিনি রুকন সম্মেলনে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি মাওলানা শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীসহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবী জানান।