২ জানুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ১২:১৪

জয় পরাজয়ে ভোটের বিস্ময়কর ব্যবধান

২০০৮ সালের ভরাডুবিতেও বৃহত্তর নোয়াখালীর ১৩টি আসনের ১০টি পেয়েছিল বিএনপি। একটি পেয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত স্বতন্ত্র। সবমিলিয়ে ১১। জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে নোয়াখালীতে ১১টি আসনে ধানের শীষের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত। ফেনীর তিনটি আসনেই জামানত হারিয়েছে বিএনপি। যেখানে কখনো হারেনি দলটি। সারাদেশে ধানের শীষের ২৮২ প্রার্থীর ১৬৩ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। হাজারের কম ভোট পেয়েছেন ১২ জন। পাঁচ হাজারের কম ভোট পেয়েছেন অন্তত ৫০ জন। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনেই এমন ফল কখনোই সম্ভব নয় বলেই সবাই মনে করছেন। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দেশে বিদেশে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের অধিকাংশ গবেষণা সংস্থা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর তদন্ত দাবি করেছেন। এছাড়া বিদেশীরাও এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ বিদেশী মিডিয়া নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করেছে। তারা বলেছে, যেভাবে ভোটের আগের দিন রাতে এবং ভোটের দিন নিয়ন্ত্রিত ভোট নেয়া হয়েছে তাকে কোনভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন বলা যাবেনা। একইসাথে নির্বাচনের যে ফলাফল বিশেষ করে ভোটের হিসেব কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই সবাই মনে করছেন।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগিরিক সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রার্থীদের জনসমর্থনের সাথে ফলাফলের কোনো মিল দেখতে পাচ্ছি না। উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু উন্নয়নের ফলে এরকম ফলাফল অস্বাভাবিক। আমি ফলাফলের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেন, জনসমর্থনতো বাস্তবিক বিষয়। এটা খালি চোখে দেখা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে আরো বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠুতা শুধু মাত্র নির্বাচনের দিনের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না। প্রাক নির্বাচনের যেসকল কর্মকা- ঘটে তার ওপরও নির্ভর করে। এই নির্বাচনের আগে অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেন নাই। যে ৬ টি আসনে ইভিএম আছে সেখানেও প্রশ্ন উঠেছে। এগুলো খতিয়ে দেখা উচিত।

সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা গুলোও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের জয় পরাজয়ে ভোটের এত বেশি ব্যবধান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ফলাফল গবেষণা করে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন । নির্বাচনে জয় পরাজয়ে ভোটের ব্যবধান এত বেশি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কারণ আমি বলতে পারবো না, তবে এত ভোটের ব্যবধান কেন হলো, এটা নিয়ে একটা গবেষণা হতে পারে। এটা গবেষণা করে দেখা উচিত। নির্বাচনী সহিংসতায় নাগরিকদের নিহতের বিষয়ে কমিশনের কাছে কী তথ্য আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে মানুষগুলো সহিংসতায় মারা গেছেন, আমরা তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিব। তারা এসব বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাও জানব। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকেও তদন্ত করবো। নির্বাচনের নানা বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে সারা দেশ থেকে মোট ৫২টি অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বেশিরভাগ অভিযোগ ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোট না দিতে বাধা প্রদান, এ রকম আসছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনের সচিবকে বলা হয়েছে। রাজধানীর গুলশান, খিলগাঁও, বনানী ও বেইলি রোডের ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে ঐক্যফ্রন্টের এজেন্ট দেখা ও নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কয়েকটি কেন্দ্রে তাদের এজেন্ট দেখেছি, কিছু কেন্দ্রে এজেন্ট দেখিনি। গুলশানের একটি কেন্দ্রে আমি তাদের এজেন্ট পাইনি।

৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ দাবি জানান দলের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম। চরমোনাই পীর বলেন, ৩০ ডিসেম্বর প্রহসনের নির্বাচনে জনগণের মতামত প্রতিফলন ঘটেনি তাই এ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি। এবং অনতিবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।

দেশে যখন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সমালোচনা চলছে তখন বিদেশী মাধ্যমগুলোও এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ ফলাফল নিয়ে প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট একটি বিশ্লেষণমূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এতে নির্বাচনের ফলাফলের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেন ওয়াশিংটন পোস্টের ইন্ডিয়া ব্যুরো চিফ জোয়ানা স্লেটার।

স্লেটার বলেন, রোববার বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশে গত এক দশকের মধ্যে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এর ফলাফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও আভাসই পাওয়া যায়নি। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার জোট সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় লাভ করেছে। এই ব্যবধানের জয় - ৯৬ শতাংশ- উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে আশা করা যায়, বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নয়। এটাই হচ্ছে সমস্যা: ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠা বাংলাদেশী নেতা হাসিনা তার ক্ষমতাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিন্তু এতে তার নির্বাচন সংক্রান্ত বৈধতাকে মূল্য দিতে হয়েছে, মন্তব্য করেন স্লেটার।

ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কোনও শান্তিপূর্ণ ঘটনা নয়। দুই প্রধান দলের সমর্থকরা প্রায়ই রাস্তায় সহিংসতায় লিপ্ত হয় এবং রোববার কমপক্ষে ১৭ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের মুখপাত্র। নির্বাচনে হাসিনা জিতবেন বলে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ অনুমান করলেও এমন বিরাট নিরঙ্কুশ বিজয় প্রায় কেউই আশা করেননি। এমনকি, গত ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়েও ভালো করেছে হাসিনার আওয়ামী লীগ। ওই বছর বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করায় অনেক জায়গায় মাত্র একজন প্রার্থী ছিলেন। ভোটকে প্রভাবিত করাসহ ভোট কেন্দ্রগুলোতে অনিয়মের বিভিন্ন খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন হাসিনা তার অনুকূলে ফলাফল পাওয়ার আশায় অন্যান্য উপায়ও অবলম্বন করেছেন। বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণার সময় সহিংসতা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। বিএনপি বলছে তাদের এক ডজন প্রার্থীকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় বিরোধী দলের প্রার্থীদের পোস্টার প্রায় দেখাই যায়নি।

শেখ হাসিনা সোমবার ভোট প্রভাবিত করার অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন এবং বিরোধী দল আরও সক্রিয় ভাবে প্রচারণা না চালানোয় তিনি বিস্মিত, জানায় রয়টার্স। একই সময়ে, বাংলাদেশের ভোটাররা কঠিন এক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছে। হাসিনা বিরুদ্ধমতের প্রতি ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন এবং ক্ষমতা ছাড়ার কোনও লক্ষণই দেখাচ্ছেন না।

রোববারের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ একটি ‘একদলীয় গণতন্ত্রের দেশে’ পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নতুন দিল্লীভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাঞ্চন গুপ্ত। হাসিনা ‘ যোগ্য কোনও বিরোধীর মোকাবেলা করছেন না’, বলেন তিনি।

এই ব্যাপক বিজয় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে ‘গুরুতর সন্দেহের’ জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আতাউর রহমান, বাংলাদেশ পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। বিরোধী দলের সামান্য সংখ্যক আসন থাকায় রাজনৈতিক নির্ভরতার কোনও উপায়ই থাকবে না।

এক্টিভিস্ট ও সাংবাদিকরা একটি ভীতিকর আবহাওয়ার বর্ণনা দেন, যেখানে সরকারের সমালোচনার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। সেপ্টেম্বর মাসে হসিনার সরকার নতুন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ আইন পাশ করেন যাতে বিশেষ ধরনের ‘ প্রোপাগান্ডার’ জন্য জেলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই আইন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে বলে মন্তব্য করেছেন সম্পাদকরা।

বাংলাদেশে ‘উন্নয়নের গল্প ঊর্ধ্বমুখী এবং গণতন্ত্রের গল্প নিম্নগামী’, মন্তব্য করেন দীর্ঘদিন ধরে দেশটির নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন এমন এক ব্যক্তি। তবে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার কারনে তিনি তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমকে আগস্ট মাসে গ্রেফতার করে তিন মাস কারাবন্দী করে রাখা হয়। সড়ক-নিরাপত্তার দাবীতে ব্যাপক আন্দোলনের ঢেউয়ের বিষয়ে ‘উসকানিমূলক’ মন্তব্য করার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যদি কারও স্বাধীনতা হরণ সবচেয়ে বড় শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে পুরো জাতিই সর্বক্ষণ এই শাস্তি পাচ্ছে,’ সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন শহিদুল আলম। ‘এটা উন্নয়নের মূল্য হতেই পারে না, এমনকি এটা উন্নয়নের সংজ্ঞাই হতে পারে না,’ বলেন তিনি।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি। এক টুইট বার্তায় এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তিনি। এতে তিনি লিখেছেন, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শনের ভয়াবহ অভিযোগ, ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদের এজেন্ট দেয়ায় বিধিনিষেধ ও বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর পুনঃনির্বাচনের দাবি উঠেছে। এসব মিলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
ওদিকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনিও রি-টুইটে বলেছেন, অবশ্যই এ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অবস্থার প্রেক্ষিতে এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতায় দুর্বলতা রয়েছে। এর বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও সহিংসতায় ১৯ জন নিহত হওয়া, বলপ্রয়োগ ও বহুমুখী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নির্বাচন ও তার ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে এতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি দেশের জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগসহ নির্বাচনী আচরণবিধির বহুমুখী লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগের কারণে নির্বাচন ও তার ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের ওপর ভিত্তি করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই সব পক্ষের জন্য সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে এসেছি। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের প্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা, হামলা ও নির্যাতনের সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। এমনকি নির্বাচনের আগের রাতে এবং নির্বাচনের দিনও এমন হয়রানি চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হলো, এতে করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি দেশের জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একটি জোটের পোলিং এজেন্টরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রে আসতে না পারার অভিযোগের বিষয়টি যেভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন তা একদিকে যেমন বিব্রতকর, অন্যদিকে নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করতে পেরেছে কিনা সে উদ্বেগ আরো ঘনীভূত করেছে। তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ লঙ্ঘন করে মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির নামে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে খোদ রাজধানীতেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিধস জয় পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এর মধ্য দিয়ে তিনি টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেন। সব মিলিয়ে তার ক্ষমতার মেয়াদ হতে যাচ্ছে চার বার। তবে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনকে হাস্যকর আখ্যায়িত করে পুনঃনির্বাচন দাবি করেছে বিরোধী দল। নির্বাচনের দিন সহিংসতায় কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হয়েছেন। এদিন ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে। নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল ও এর মিত্ররা ২৮৮ আসনে বিজয়ী হয়েছে। নির্বাচনের পরে এসব কথা লিখেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

এর মধ্যে অনলাইন বিবিসির শিরোনাম ‘বাংলাদেশে নির্বাচন: শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নতুন মেয়াদে নির্বাচিত’। এতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সোমবার বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে ভূমিধস বিজয় পেয়েছেন। এর আগে তার দল যে রেকর্ড গড়েছিল সেই রেকর্ডকে এ নির্বাচন অতিক্রম করেছে। বিরোধীরা এ নির্বাচনকে হাস্যকর উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে। নতুন করে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা। এ নির্বাচন সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন ও জালিয়াতির বলেও তারা এর নিন্দা জানিয়েছে। বিরোধীদলীয় জোট মোট সাতটি আসনে বিজয়ী হয়েছে। এ জোটের নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে হাস্যকর এই নির্বাচনের ফল বাতিল করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। বিবিসি আরো লিখেছে, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের নেতৃত্বে রয়েছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। কিন্তু ব্যালটবাক্স ছিনতাই করার অভিযোগ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। বিএনপির একজন মুখপাত্র অভিযোগ করেছেন, ৩০০ আসনের মধ্যে ২২১টিতে অনিয়ম হয়েছে। ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই বিবিসির একজন সংবাদদাতা দেখতে পেয়েছেন, ব্যালটভর্তি ব্যালটবাক্স চট্টগ্রামের একটি ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান প্রিজাইডিং অফিসার।

সেখানে শুধু ক্ষমতাসীন দলের পোলিং এজেন্টরা ছিলেন। অন্য ভোটকেন্দ্রেরও একই অবস্থা। ভোট জালিয়াতি ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে প্রধান বিরোধী দলের কমপক্ষে ৪৭ জন প্রার্থী তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। অধিকার বিষয়ক কর্মীরা, পর্যবেক্ষকরা ও বিরোধী দল সতর্ক করেছিল আগেই। তারা বলেছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের শিরোনাম ‘নির্বাচনে বড় বিজয় পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীরা জালিয়াতির অভিযোগ করছেন’। এতে বলা হয়, অস্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার জোট বিজয়ী হয়েছেন। তবে বিরোধীরা জালিয়াতির অভিযোগে এ নির্বাচন বর্জন করেছে। ভারতের আঞ্চলিক শক্তির খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে। তারা পার্লামেন্টের ২৮৮ আসনে বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জিতেছে মাত্র ৬টি আসনে।

এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল তারা। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা তার শাসনকে আরো সুসংহত করলেন। তাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয়। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়ার বিরুদ্ধে দমনপীড়ন ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনের মতো অভিযোগ রয়েছে তার সরকারের বিরুদ্ধে। তবে তিনি এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ওদিকে নির্বাচনের আগে কয়েক মাসে বিরোধীদলীয় কয়েক শত নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। তারা বলছে, বানোয়াট অভিযোগে এসব নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, তারা যাতে প্রচারণা চালানোর ক্ষমতা না রাখেন এজন্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।

বার্তা সংস্থা এপি’র শিরোনাম ‘শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন জোট বাংলাদেশের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে- নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা’। এতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন জোট ২৮৮ আসনে বিজয়ী হয়েছে। সরকার গঠন করার জন্য এ সংখ্যা যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ সোমবার সকালে এ ফল ঘোষণা করেছেন। নির্বাচন কমিশনের এ ফলের অর্থ হলো টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করবেন শেখ হাসিনা, যদিও বিরোধীরা অভিযোগ করছে তিনি ক্রমশ বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছেন। বিরোধীরা এ নির্বাচনকে বর্জন করেছে। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিজয়ী হয়েছেন। তিনি শেখ হাসিনার কড়া সমালোচক। যে ফলই আসুক তিনি তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন রোববার। তবে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর কি করবেন তা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায় নি। ভারতের অনলাইন দ্য হিন্দুর শিরোনাম ‘বাংলাদেশের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় শেখ হাসিনার, বিরোধীরা নতুন ভোট চাইছেন’। এতে বলা হয়, ভূমিধস বিজয়ে চতুর্থবার ক্ষমতা নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনা। বিরোধীরা এতে ভোট জালিয়াতি, সহিংসতায় কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হওয়ার অভিযোগে নির্বাচনকে হাস্যকর বলে আখ্যায়িত করেছে।

অনলাইন দ্য ইকোনমিক টাইমসের শিরোনাম ‘ শেখ হাসিনার ভূমিধস বিজয়, বিরোধীরা পুনঃনির্বাচন চান’। স্ক্রল ডট ইন-এর শিরোনামও একই রকম।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ‘স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত’ ছিল বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। বিবিসি, সিএননসহ পশ্চিমা মিডিয়ার অবস্থান ‘অত্যন্ত হতাশাজনক ও পক্ষপাতদুষ্ট’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নির্বাচনের পরদিন মধ্যরাতে সামাজিকে যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে জয় এ কথা বলেন। নিজের ফেসবুক ভেরিফায়েড পেইজে জয় লেখেন, নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, ৩ কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে ১টি আসনে। এই কেন্দ্রগুলোর ভোট বাতিল করে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হবে। যারা বলছেন কারচুপি হয়েছে, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, তারা কি বুঝতে পারছেন এই নির্বাচন ফলাফল অন্যরকম হওয়ার জন্য বিরোধীদলগুলোর ২.৫ কোটিরও বেশি ভোটারের সমর্থন প্রয়োজন ছিল? যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

http://www.dailysangram.com/post/359444