৬ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ১১:০৯

বানভাসিদের বাড়ছেই দুর্ভোগ

দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত নদ-নদীগুলো ফুলে-ফুঁসে উঠেছে। গতকাল শুক্রবার উত্তরাঞ্চলে বন্যার সার্বিক অবনতি হয়েছে। চলমান বন্যার মধ্যাঞ্চলেও বিস্তার ঘটেছে। মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইল ও মেঘনা-ব্রিজ এলাকায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দেখা দিয়েছে বন্যা পরিস্থিতি। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোতেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষত বৃহত্তর সিলেট ও নেত্রকোণায় বন্যা পরিস্থিতি কোথাও উন্নতি, কোথাও প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে টানা বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে ভারতের প্রবল ঢলে মৌসুমী মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গতকাল ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট, মেঘনা, সুরমা-কুশিয়ারাসহ ৮টি নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। দশটি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে।

এর মধ্যেই পানি আরো বাড়তে থাকায় উত্তরের নিম্নাঞ্চলে বন্যা অবনতির দিকে রয়েছে। সেই সাথে উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল এমনকি পদ্মা ও মেঘনার ভাটির অববাহিকা পর্যন্ত ক্রমেই বাড়ছে নদীভাঙনের তা-ব। সর্বত্র বানভাসি ও পানিবন্দি লাখো মানুষের দুঃখ-দুর্গতি, দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। বন্যার পানিতে একের পর এক তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, সবজিক্ষেত-খামার। কৃষকের মাথায় হাত। সর্বত্র ঢল-বানের কারণে সাপের ভয়-আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

অন্যতম বৃহৎ অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা উভয় নদের পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে অবস্থানের সাথে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে এই অববাহিকার সাথে যুক্ত আরো শাখা নদী, উপনদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়ছে উজান থেকে আসা ঢলের কারণে। উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের চর, দ্বীপ-চর ও নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। নদ-নদী সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বন্যা বিস্তার লাভ করছে। দেখা দিয়েছে ভয়াবহ নদীভাঙন। সার্বিকভাবে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতিতে রয়েছে এসব অঞ্চল। ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে ভারতের ঢল আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস রয়েছে পাউবো’র। বন্যার কারণে গবাদি পশু-পাখির খাদ্য সঙ্কট প্রকট।

গতকাল বিকাল পর্যন্ত পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘটসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ জেলাগুলোতে বন্যা পারিস্থিতি আরো অবনতির দিকে রয়েছে। মধ্যাঞ্চলে ক্রমেই নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে টাঙ্গাইল ও মেঘনা নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগেই বন্যা কবলিত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কোথাও ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, কোথাও প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত বিপদসমীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো হচ্ছেÑ ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা, সোমেশ^রী ও মেঘনা।
দেশের অন্যতম বৃহৎ অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি পয়েন্টের সবক’টিতেই বিপদসীমার উপর দিয়ে গতকাল বিকাল পর্যন্ত আরও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৭১ সেন্টিমিটার, হাতিয়া পয়েন্টে ৮০ সে.মি. এবং চিলমারী পয়েন্টে ৭৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনা নদে পানি আরো বেড়ে গিয়ে দশটি পয়েন্টের মধ্যে ৮টিতেই বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৮, বাহাদুরাবাদ ও সাঘাটায় ৯৩, সারিয়াকান্দিতে ৫৬, কাজীপুর ৫২, জগন্নাথগঞ্জে ১০২, সিরাজগঞ্জে ৪৭ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জে যমুনার ভাঙনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যমুনা নদের পানি মধ্যাঞ্চলে ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়িতে ১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঢাকার কাছে মধ্যাঞ্চল ও মধ্য-পূর্বাঞ্চলে মেঘনা নদীর পানি মেঘনা-সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৩ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী গাইবান্ধায় ঘাঘট নদী বিপদসীমার ৩৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা কুড়িগ্রামে বিপদসীমার মাত্র ৯ সে.মি. নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদী পাটেশ^রীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ সে.মি. নিচে, তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে ৩৩ সে.মি. নিচে অবস্থান করছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি কোথাও প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে, কোথাও হ্রাস পাচ্ছে। পুরাতন-সুরমা দিরাইয়ে এবং সোমেশ^রী নদী কলমাকান্দায় বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুলেটিনে কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ধীরগতিতে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। বৈশি^ক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে ভারতে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলাসমূহের যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদী গোয়ালন্দ পয়েন্টে সতর্কসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ঘাঘট নদীসমূহের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি কতিপয় পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। ঘাঘট নদী সংলগ্ন গাইবান্ধা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনেশ^রী, করতোয়া, বাঙ্গালী, আপার-করতোয়া, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, ইছামতী-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট-যমুনা নদীগুলোর পানি সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

পাউবো’র পর্যবেক্ষণাধীন দেশের ১১০টি নদ-নদীর পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৬৭টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ৪১টিতে হ্রাস পায়। ২টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত ছিল। বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ও বিপদসীমায় রয়েছে ৮ নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে। বন্যা কবলিত হয়েছে ১০টি জেলা। গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে ১০৯, পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে ৯৪, আসামের গোয়াহাটিতে ৬৩ মিলিমিটার।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, অতিবর্ষণ ও উজানের পাহাড়ী ঢলে বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার উপজেলার নিচু এলাকায় দুই হাজার বাড়িগর বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পূর্ব বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, ধুনট এবং সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ ত্রানের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ধারণা করছেন, আজ থেকে নিম্নচাপজনিত কারণে সৃষ্ট অতিবর্ষণ থেমে গেলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হবে।

স্টাফ রিপোর্টার, শেরপুর সীমান্ত অঞ্চল থেকে জানান, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত কমে আসায় মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। শেরপুর সীমান্ত অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পানিবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি মিললেও বন্যায় কাঁচা সড়ক, বীজতলা, সবজি ক্ষেত ও মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন বন্যা কবলিত লোকজন। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ও মৃগী নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। ফলে শেরপুরের বেশ কয়েকটি এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে শেরপুরের ৩টি নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। পানি কমে আসায় ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। এখনও পানিবন্দি রয়েছে হাজারো পরিবার।

কামারের চর ও বাগলদী গ্রামের ইমরান গাজী বলেন, ২ উপজেলার বিভিন্নস্থানে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে শতাধিক মাছের ঘের, বিধ্বস্ত হয়েছে শতাধিক বসতবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচা-পাকা সড়ক। পানিবন্দি রয়েছে হাজারো মানুষ। নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রামেই জলাবদ্ধতা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের বীজতলা, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও গাছপালা। ঝিনাইগাতী সদরের ব্যবসায়ীরা আজাহারুল ইসলাম বলেন, ঝিনাইগাতীতে প্রবল ঢলের স্রোতে মহারশী, সোমেশ্বরী নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে ঝিনাইগাতী বাজার, উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিষদসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। রামেরকুড়া, খৈলকুড়া, দিঘিরপাড়, ধানশাইল, কাংশা, ঝিনাইগাতী, চতল ও বনগাঁওসহ অন্তত ৩০-৪০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করে।

ঝিনাইগাতীর ধানশাইল ইউনিয়নের উত্তর দাড়িয়াপাড় বড়বাড়ির খোরশেদ আলম আকন্দ ও কান্দুলীনামা পাড়া গ্রামের বিধবা হালিমা বেগম বলেন, আমগোর নৌকা নাই। পানি আওনের পর থাইকা কোনো বাড়িতে যাইতে পারি না। কেউ আইতেও পারে না। পানি ঘরে আইছে, রান্ধিমু কই? ৩-৪ দিন ধরে মুড়ি-চিড়া খাইয়া বাইচ্যা আছি। ঘরে অন্তঃস্বত্ত্বা মেয়ে, বৃদ্ধা শাশুড়ি, ছোট বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টে আছি। ঝিনাইগাতী সদরের বাসিন্দা ও সাবেক ছাত্র নেতা বনিক সমিতির সাবেক সেক্রেটারী সমাজ সেবক ফারুক আহমেদ বলেন, বন্যায় বার বার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ঝিনাইগাতী শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে না। ফলে ঢলের পানিতে বন্যার সৃষ্টি হলেই ব্যবসায়ী ও লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়ে ও ঘরবাড়ি ভেসে যায়। প্রতি বছর এভাবে আমাদের ক্ষতি হয়। তবুও শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে না। তিনি অবিলম্বে ঝিনাইগাতী শহর রক্ষা বাধ নির্মাণের জন্য জোর দাবি জানান।

তাছাড়া নালিতাবাড়ীর ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীতে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢলে সন্নাসীভিটা নয়াপাড়ায় ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। গড়কান্দায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। খালভাঙ্গায় অন্তত ৩-৪’শ মিটার বাঁধ উপচে আশপাশের এলাকায় ঢলের পানি প্রবেশ করে। গোল্লারপাড়য় শেরপুর-নালিতাবাড়ী সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। ব্যাহত হয় যানচলাচল। পানি নেমে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

এদিকে নদীগুলোর ভেঙে যাওয়া বাঁধ জরুরি মেরামতের জন্য কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্ভিদ সংরকণ) কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির বলেন, ঝিনাইগাতী উপজেলায় ২০ হেক্টর রোপা আমনের বীজ তলা, ১৫ হেক্টর আউশ এবং ৯৮ হেক্টর সবজি খেত আংশিক নিমজ্জিত হয়েছে। একই সঙ্গে ১০ হেক্টর রোপা আমন বীজতলা, ১৩৫ হেক্টর আউশ ও ১২৬ হেক্টর সবজি ক্ষেত সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে। দ্রুত পানি নেমে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। নালিতাবাড়ী উপজেলায় ৫ হেক্টর রোপা আমন বীজলা আংশিকভাবে এবং ২০হেক্টর রোপাআমন বীজতলা সম্পূর্ণভাবে পানিতে ঢুবে গেছে। তবে পানি স্থায়ী না হলে, বীজতলার তেমন ক্ষতি হবে না।

ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, পাহাড়ি ঢলে যে সব রাস্তাঘাট, বাঁধ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, সেগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নকিবুজ্জামান খান বলেন, পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার যে বাঁধগুলোর ক্ষতি হয়েছে সেগুলো মেরামতের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। পানি উজান থেকে নামতে শুরু করেছে। এদিকে শেরপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশ্রাফুল আলম রাসেল গতকাল শুক্রবার ঝিনাইগাতীর মহারশী নদীর ভাঙনকৃত বাঁধগুলো পরিদর্শন করেছেন এবং দ্রুত বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করবেন বলে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়ে পড়েছে নতুন নতুন এলাকা। গত বৃহস্পতিবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৭২ সেন্টিমিটার এবং হাতিয়া পয়েন্ট বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি, পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার এবং শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমা নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যার পানি প্রবেশ করায় জেলায় ৩৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দুই হাজার ৩০০ হেক্টর ফসলি জমি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। চিলমারী থেকে রৌমারীগামী ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।

নদ-নদী তীরবর্তী চর ও নিম্নাঞ্চলের বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষজন। অনেক পরিবার গবাদিপশুসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ অবস্থায় দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাষীদের। পানি বন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা মতিউর বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের পানি ঘরের চারপাশে আসছে। গবাদিপশু নিয়ে দুঃচিন্তায় আছি।’ বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চরের মতিয়ার রহমান জানান, আমার চরের প্রতিটি বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। কেউ নৌকা, কেউ বা মাচান করে উঁচু স্থানে রয়েছেন। এখানকার প্রতিটা পরিবার খুব কষ্টে আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি আরও ৪৮ ঘণ্টা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের পানি তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যন্য নদ নদীর পানি বিপদসীমা নিচে রয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানান, এখন পর্যন্ত বানভাসীদের জন্য ৯ উপজেলায় ১৭৩ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মজুত আছে ৬০০ মেট্রিক টন চাল ও ৩০ লাখ টাকা। যা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে গত কয়েক দিনের লাগাতার ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তিস্তায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় দফার এ বন্যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বানভাষিদের দুর্দশা বৃদ্ধি পেলেও প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অনেক কম।

সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যায় উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হচ্ছে তারাপুর, বেলকা, দহবন্দ, হরিপুর, শান্তিরাম, কঞ্চিবাড়ী, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর। গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়েছে। বন্যায় চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বন্যা থেকে রক্ষার্থে স্থায়ী ও অস্থায়ী ৪৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। পানিবন্দী মানুষরা গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, উচু স্থান, আতœীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশিদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে গতকাল শুক্রবার বিকেল তিনটায় বিপদ সীমার ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির লেভেল- ২০.২৩ মিটার। ডেঞ্জার লেভেল- ১৯.৩৫ মিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় পানির উচ্চতা ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফুলছড়ি থেকে উত্তরে অর্থাৎ উজানে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। দুঃখের বিষয় সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর বন্যার পানির স্তর পরিমাপের স্টেশন এতোদিনেও স্থাপন করা হয়নি। তীরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং তা ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল বলেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার্থে সকল ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৫৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে ২৫ হাজার মানুষ। বন্যা কবলিতদের জন্য ৩০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ১১ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। মেডিকেল টিম, কৃষি টিম, স্বেচ্ছাসেবক টিম এবং লাইভস্টোক টিম গঠন করা হয়েছে।

ইসলামপুর (জামালপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে জামালপুরের যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ইসলামপুর উপজেলার মোট ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৬৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এ এল এম রেজুয়ান জানান, উপজেলায় মোট দুই হাজার ৭’শ ৮০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

এদিকে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ইসলামপুর উপজেলায় ২৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান, প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফেরদৌস। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান টিটু জানান, বন্যার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য ১২০ মেট্টিক টন চাল ও ৩২০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। জানাগেছে, ইসলামপুর সদর ইউপি ও পচাবহলা জামেদ আলী দাখিল মাদরাসায় ৬ শত বানভাসীদের মাঝে ১০ কেজি করে চাউল বিতরণ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম।

https://dailyinqilab.com/national/article/669388