১ জানুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:৩৭

নির্বাচন ও কিছু কথা

ড. মো. নূরুল আমিন : গত ৩০ ডিসেম্বর রোববার দেশব্যাপী একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৯, বিএনপি ৫, জাতীয় পার্টি ২০, ওয়ার্কার্স পাটি ৩, জাসদ ২, গণ ফোরাম ২, তরিকত ফেডারেশন ১, বিকল্পধারা ২ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। সারা দেশে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের আগের রাতেই নৌকা প্রতীকে সীল মেরে বাক্স ভর্তি করা, ধানের শীষের এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া ও কেন্দ্র থেকে বাইর করে দিয়ে নির্যাতন করা, ভোটারদের ভোট দানে বাধা প্রদান, জাল ভোট প্রদান, কেন্দ্র দখল, বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের কোনঠাসা করা ও তাদের কর্মীদের গ্রেফতার হয়রানি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রীয়তা ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি ছিল এই নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থায় সারা দেশে ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত পুন:নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন।

তিনি বলেন সারা দেশে ঐক্যফ্রন্টের এজেন্ট বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখল করে ইচ্ছামত নৌকা মার্কায় সীল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের ভোটাধিকার ছিনতাই করা হয়েছে। এটা নির্বাচন নয়, জাতির সাথে প্রহসন। তিনি বলেন, এই প্রহসনের নির্বাচন আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এবং সেই সাথে অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দাবি করছি।

বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই নির্বাচনকে জাতির সাথে নিষ্ঠুর প্রহসন বলে অভিহিত করে বলেছেন যে, এই নির্বাচন জাতির জন্য ক্ষতিকর এবং এই ক্ষতি দীর্ঘকালের। ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন রোববার দুপুরে এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন যে, সারা দেশে পুলিশ ও র‌্যাবের পাহারায় এই দিন যে ভোট ডাকাতির মহোৎসব হয়েছে তা দেশের জন্য এক কলংকজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। নির্বাচনে সরকার দলীয় প্রার্থী ও তাদের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস হুমকি-ধামকি, হামলা, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, বিরোধী প্রার্থীদের অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নিরপরাধ কর্মীদের গ্রেফতার হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা উৎসবের নির্বাচনকে আতঙ্কের নির্বাচনে পরিণত করেছে।

দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-৪ আসনের প্রার্থী সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ ভোট কেন্দ্র দখলের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছেন। খেলাফত মজলিসের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ভোটের নামে সারাদেশে ভোট ডাকাতির মহোৎসবের তীব্র নিন্দা করে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং পুনঃতফসিলের দাবি জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে, সকাল থেকে অধিকাংশ আসনে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে খেলাফত মজলিস, ২০ দলীয় জোট তথা ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের এজেন্টদের মারপিট, ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল করে নৌকা মার্কায় সীল মারা, বিভিন্ন স্থানে হামলা, গ্রেফতার ও হত্যাকা-ের মতো মর্মান্তিক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে।

তিনি আরো বলেছেন, ভোট কেন্দ্রে এসব অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে এবং জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। তিনি তার বিবৃতিতে এই সাজানো নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তা বাতিল ও পুনঃনির্বাচনের দাবি জানান। বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন শাসক দল ভুয়া বিজয় নিশ্চিত করার জন্য এই নির্বাচনে আগে থেকেই ৩/৪ ধরনের প্রহসন ও কারচুপির বলয় তৈরি করে রেখে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ন্যূনতম ভিত্তিকে বলি দিয়েছে। তিনি এই নির্বাচনকে ভুয়া ভোটে ভুয়া নির্বাচন বলে অভিহিত করেন।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী সাংবাদিকদের বলেছেন যে, তাদের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী শাসক দল আওয়ামী লীগের লোকজন নির্বাচনের আগের দিন রাত্রেই বেশির ভাগ কেন্দ্রের ব্যালট পেপারে সীল মেরে বাক্স ভর্তি করে রেখেছে। সরকারের এক সময়ের ‘অনুগত বালক’ ইমরান এইচ সরকারের মতে ভোটের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীনরা ব্যালট পেপারে সীল দিয়ে বাক্স ভর্তি করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেছেন, এবারের ইলেকশনে সিলেকশানের কাজটি আগের তুলনায় নিখুঁত।

তিনি বলেন ভোটের এক মাস আগে থেকেই যে হামলা মামলা ও ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল তার ফলে ভোট ডাকাতি সহজ হয়েছে। সরকার নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতায় কাজটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে করেছেন বলে ভোটের দিন সংঘাত বা অশান্তির মাত্রা তত দৃশ্যমান হয়নি। তার দলের প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি জানান যে, ভোটের আগের রাতেই ক্ষমতাসীনরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ব্যালটে সীল মেরে রেখেছিল। বাকীটা সেরেছে এজেন্টদের বাইর করে দিয়ে। এর আগে ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যাপক জালভোট প্রদান, ব্যালট ডাকাতি ও ভোটের আগের রাতেই দেশের অধিকাংশ স্থানে সরকারি দলের নৌকা প্রতীকে সীল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত করার নির্বাচনের দিন দুপুরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বয়কট করার ঘোষণা দিয়ে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল ও পুনরায় তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।

তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেন, আমরা বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে জনগণের সকল প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে গত ২৯ ডিসেম্বর রাতেই দেশের অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ব্যালট পেপারে নৌকাপ্রতীকে সীল মেরে ব্যালট কেটে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। ভোটের দিন ভোট শুরুর সময় জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাবার চেষ্টা করলে অধিকাংশ কেন্দ্রে তাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই ভোটারদের উপর হামলা করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী ও ভোটাররা আক্রমণের শিকার হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। দেশের সর্বত্রই নির্বাচনের নামে প্রহসনের নগ্নচিত্র ফুটে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো নির্বাচনই নয়। নির্বাচনের নামে এটি একটি ব্যালট ডাকাতির প্রহসন এবং জনগণের সাথে প্রতারণা। তিনি বলেন, ভোটার ও সাধারণ জনতার ওপর সরকারের অব্যাহত হামলায় জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োজন তো দূরের কথা জানমালের কোনোই নিরাপত্তা নেই। এই একতরফা নির্বাচনকে কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতের প্রার্থীদের তিনি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বয়কটের ঘোষণা দেন এবং পুনঃতফসিলের আহ্বান জানান।

বলাবাহুল্য, এই নির্বাচনে সহিংস ঘটনায় নির্বাচনের দিন ২১ জন লোক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে সহস্রাধিক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই দিন হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সম্ভবত এই সংঘাত সংঘর্ষ তাদের গোচরিভূতই ছিল।

পাতানো এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তৃতীয়বারের মতো সিংহাসনে বসতে যাচ্ছে।

গত ১০ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনে নিগৃহীত জনগণের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। ১০ বছর ধরে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। নির্বাচনের আগে তাদের মামলা তোলা হয়নি, তফসিল ঘোষণার পরও তাদের নতুন মামলায় জড়ানো হয়েছে। তাদের অনেকের বাড়ি-ঘর এমনকি সম্পত্তি দখল হয়েছে। দলের জন্য, আদর্শের জন্য সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এখন সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও ফ্যাসিবাদের কাছে সবাই কি হেরে যাবেন ? দাবি আদায় ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়ায় সরকার লাভবান হয়েছে এবং বিরোধী দল আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলের জরুরি বৈঠক হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ঐক্যফ্রন্টসহ অনেকগুলো দল নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন।

গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার বাংলাদেশের প্রাণ। এই গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার না থাকলে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে না। অধিকৃত কাশ্মীর অথবা লেন্দুপ দর্জির দেশের ন্যায় পরাধীন-আশ্রিত দেশ হবার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। গণতন্ত্র যদি না থাকে, মানুষের ভোটাধিকার যদি না থাকে, তাহলে এদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ লোক যারা এদেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আমরা তা করতে পারি না, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করা এই জাতির ঈমানী দায়িত্ব। এ প্রেক্ষিতে প্রহসনের এই নির্বাচনী ফলাফল বাতিল এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচনের দাবি সব দিক থেকেই যৌক্তিক।

বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে দেখা যায় যে আমাদের প্রথম সংসদের মেয়াদ ছিল ২ বছর ছয় মাস, দ্বিতীয় সংসদের ২ বছর ১১ মাস, তৃতীয় সংসদের ১ বছর ৫ মাস, চতুর্থ সংসদের ২ বছর ৭ মাস, পঞ্চম সংসদের ৪ বছর ৮ মাস, ষষ্ঠ সংসদের ১২ দিন। ২০১৪ সালের অনির্বাচিত সংসদকে বে-আইনীভাবে দেশবাসী বৈধতা দিয়ে দিয়েছে। যদি না দিত তা হলে আজকের এই অবস্থা হতো না। কাজেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে একাদশ সংসদকে বাতিল করে সরকারের উচিত নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

শেষ করার আগে আরেকটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে আধুনিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ১৮৬৩ সালে ১৯ নবেম্বর আমেরিকান গৃহযুদ্ধের অন্যতম ক্ষেত্র গেটিসবার্গে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণটি সারা দুনিয়ার গণতন্ত্র প্রেমীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে বিরাজ করছে।

গেটিসবার্গ ছিল Battlefild এখন জাতীয় কবরস্থান বা National Cemetery এই কবরস্থানকে সাক্ষী রেখে তিনি দেশের জন্য জীবন দানকারী শহীদদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন আমাদের শহীদদের সাথে যার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “The World will little note, nor long remember what we say here, but it can never forget what they did here. It is for us the living, rather, to be dedicated here to the unfinished work which they who fought here have thus so nobly advanced ... that from these honored dead we take increased devotion to that cause for which they gave the last full measure of devotion, that we here highly resolve that these dead shall not have died in vain, that this nation under God shall have a new birth of freedom; and that government of the people, by people, for the people shall not perish form the earth.

আমাদের শহীদ যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে দেশ গণতন্ত্র কোনোটাই রক্ষা করা যাবে না।

http://www.dailysangram.com/post/359296