১৯ ডিসেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:২২

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রশ্নেও বিভক্ত ইসি

একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। গত সোমবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটা এখন একটা অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে। গতকাল এ মন্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। তিনি বলেছেন, ‘মাহবুব তালুকদার সত্য বলেননি। নির্বাচনের সামগ্রিক পরিস্থিতি ভালো রয়েছে।’ গতকাল মঙ্গলবার রাঙ্গামাটিতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি এ কথা বলেন।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আসলে কিভাবে হবে এখনই বলা যাচ্ছে না। এমপি, মন্ত্রিত্ব রেখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হওয়ার সুযোগ কম। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ সহিংসতা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে তাদের কাজ করছে না অথবা করতে পারছে না। আসলে কী ঘটছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে সমান প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে কিছু ফাঁকা বুলি ছাড়া কোনো ইতিবাচক দৃষ্টান্ত এখনো কমিশন স্থাপন করতে পারেনি, যা অত্যন্ত বিব্রতকর। নির্বাচনের প্রচারণার শুরু থেকেই প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যক্রমে উপর্যুপরি মামলা-হামলার মাধ্যমে বাধাদান, হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন মোকাবেলায় নির্বাচন কমিশনের ক্রমাগত ব্যর্থতা এমনকি আত্মমর্যাদাশীল উদাসীনতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দেখা গেছে। জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে পাঁচ সদস্যের এই কমিশনে বিভক্তিও বাড়ছে।
এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়ন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিভক্ত আদেশ দিয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিবেচনায় তিন আসনেই তার মনোনয়ন অবৈধ বলে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেয়া আদেশ বহাল রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়া এবার ফেনী-১ এবং বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু, দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তার তিনটি মনোনয়নপত্র বাতিল করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। ওই দিন সন্ধ্যায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি করে নির্বাচন কমিশন। সেখানে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী মনোনয়ন বৈধতার বিষয়ে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন।
সেখানে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আইনি দিক বিবেচনায় আমি খালেদা জিয়ার মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করে রিটার্নিং কর্মকর্তার দেয়া সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে মনে করছি। তিন আসনেই তার প্রার্থিতা আমি বৈধ বলে ঘোষণা করছি।’
শুনানিতে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করলেও সিইসি কে এম নূরুল হুদা এবং বাকি তিন কমিশনার শাহাদাত হোসেন, রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর করেছেন।

এর আগে নির্বাচন কমিশনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, অথচ নির্বাচন কমিশনারদের সবাই সেসব বিষয়ে অবগত নন। কমিশনারদের না জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পরামর্শে কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ করছেন ইসি সচিব। এমন কয়েকটি ঘটনায় ক্ষুব্ধ চার কমিশনার সচিবকে আনঅফিসিয়াল নোট (ইউও নোট) লিখে কমিশনের ঘটনাবলি জানাতে বলেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনারদের এমন নোটের ফলে ইসির কার্যক্রমে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সভা হয়। ওই সময় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আইন সংশোধনের প্রস্তাবে আপত্তি দিয়ে সভা ত্যাগ করেন মাহবুব তালুকদার। এর দেড় মাস পর ১৫ অক্টোবর কমিশন সভায় যোগ দিয়েই বাকস্বাধীনতা ‘কেড়ে নেয়ার’ অভিযোগ তুলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে আবারো কমিশন সভা বর্জন করেন তিনি। কমিশনের ৩৬তম সভা শুরুর পর ১০ মিনিটের মাথায় তিনি সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে অন্য তিন নির্বাচন কমিশনার মো: রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে বৈঠক চালিয়ে যান সিইসি নুরুল হুদা।
নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে সভা বর্জনের বিষয়ে ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিকেলে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, গত বছর আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় তিন মাস নির্বাচন কমিশন অংশীজনের সাথে সংলাপের আয়োজন করে। ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ছাড়াও সুশীলসমাজ, মিডিয়া, পর্যবেক্ষণকারী, নারী নেত্রী প্রমুখ সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

মাহবুব তালুকদার বলেন, তবে এই সংলাপ ছিল একপক্ষীয়। নির্বাচন কমিশন কেবল তাদের বক্তব্য শুনেছে, নিজেদের কোনো মতামত দেননি। সবার সংলাপ সুদৃশ্য গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হলেও সংলাপের সুপারিশ বা প্রস্তাব সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। সংলাপের কোনো কার্যকারিতা না দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমি ওই সংলাপ পর্যালোচনা করে কমিশন সভায় কিছু প্রস্তাব পেশ করতে চেয়েছিলাম এবং কমিশনের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলাম।
তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনা শিরোনামে আমি যা আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, নির্বাচন কমিশন সভায় তা উপস্থাপনা করতে দেয়া হয়নি। তিনি জানান, গত ৮ অক্টোবর কমিশন সচিবালয় থেকে ইউও নোটের মাধ্যমে আমাকে আজকের সভায় তা উপস্থাপনার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। আমাকে আমার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে বলেও আজ তা না দেয়ায় আমি অপমানিত বোধ করেছি।
মাহবুব তালুকদার বলেন, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা আমার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। বাধ্য হয়ে আমি নির্বাচন কমিশনের এ রকম সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করেছি এবং এর প্রতিবাদস্বরূপ নির্বাচন কমিশন সভা বর্জন করেছি। কমিশন সভায় উপস্থাপনার জন্য তৈরি প্রস্তাবনাগুলোও তুলে ধরেন তিনি।
নোট অব ডিসেন্টে তিনি লিখেছেন, নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার অধিকার খর্ব করতে পারে না, বাকস্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা আমার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে আমি নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করছি এবং প্রতিবাদস্বরূপ কমিশন সভা বর্জন করছি।
মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, কমিশন সভায় তাকে বক্তব্য উপস্থাপন করতে না দেয়ার বিষয়ে কমিশনারদের ‘অভিন্ন অবস্থান’ তাকে ‘বিস্মিত ও মর্মাহত’ করেছে। ওই পাঁচ দফা প্রস্তাব কমিশন সভার কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করারও অনুরোধ করেছেন এই নির্বাচন কমিশনার।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/373684