১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩১

সস্তার দিন শেষ হয়ে যায় ২০০৬ সালের পর

তিন দশকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-শেষ

বাংলাদেশে সস্তার দিন শেষ হয়ে যায় ২০০৬ সাল থেকে। এটা গত তিন দশকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিসাব অনুসারে। মূলত ২০০২ সাল থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমে চড়া হতে থাকে। স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে তখন প্রতিদিনকার আলোচিত বিষয় ছিল জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত টানাপড়েন তথা ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনে তাদের ঘাত-প্রতিঘাত ও অশান্তি। কিন্তু ২০০৬ সালের পর থেকে অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে রীতিমত দুর্যোগ বয়ে আনে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের দেখা যায় ২০০১ সালে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা মাত্র ১ ভাগ। ২০০২ সালে হঠাৎ করে এ বৃদ্ধি ৪ ভাগে উন্নীত হয়। ২০০৫ সালে এটা বেড়ে শতকরা ৬ ভাগে দাঁড়ায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তখন এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছায় যে, ২০০৬ সালে শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায় জিনিসপত্রের দাম। আর ২০০৭ সালে এটা আরো বেড়ে হয় শতকরা ১৮ ভাগ।
ক্যাবের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ হার নির্ণয়ে চাল ডালের সাথে শাড়ি লুঙ্গি, ফলফলাদিসহ হরেক রকম জিনিস রয়েছে। তারপরও গড়ে প্রতি ১০০ টাকার জিনিসের দাম ২০০৭ সালে বেড়ে ১১৮ টাকা দাঁড়ায়। বাস্তবে প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় কিছু কিছু অপরিহার্য জিনিসের দাম খুবই স্বল্প সময়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যেমন চাল আটা তেল ডাল। আবার কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। যেমন গরুর গোশত ও মাছসহ বিভিন্ন পণ্য।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে জীবন যাত্রার ব্যয়। ২০০১ সালে জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় শতকরা ৫ ভাগ। আর ২০০৬ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৩ ভাগ। ২০০৭ সালে বাড়ে শতকরা ১৬ ভাগ।
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ইতিহাসে ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়কাল স্মরণীয় হয়ে আছে। অনেকে আজো ভুলতে পারেন না সে সময়কার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত দুরবস্থার কথা।
রাজধানীর শান্তিনগরে বসবাসরত আলতাফ হোসেন বলেন, আমি ১৯৯১ সালে ঢাকায় আসি। তখন আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। পড়ালেখা শেষ করার পর চাকরি নিয়ে ২০০২ সালে আমি সংসার শুরু করি। শুরুতে মিরপুর ১২ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমি সেখানে ছিলাম। সে সময় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কথা আমার মনে আছে। একটা সময় পর্যন্ত জিনিসপত্রের দাম সত্যিকার অর্থেই পানির মতো সস্তা ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালের দিকে জিনিসপত্রের দাম এমনভাবে বাড়তে থাকে যে, আমরা তা কল্পনাও করতে পারিনি। মনের দুঃখে রাগে তখন অনেক জিনিসপত্র কেনা বাদ দিলাম। আমার মনে আছে আমি নিয়মিত মিল্কভিটা দুধ কিনতাম। কিন্তু এ সময় কয়েক দিন পর পর দুই টাকা করে লিটার প্রতি দাম বাড়ত। ফলে ক্ষোভে এক সময় এটা কেনা বন্ধ করে দিলাম। এভাবে গরুর গোশত ও আটাসহ আরো অনেক কিছু বাদ দিতে বাধ্য হলাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলতাফ বলেন, শুধু জিনিসপত্রের দাম যে তখন অতিমাত্রায় বেড়েছে তা নয়। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাড়ি ভাড়া। পাঁচ হাজার টাকার বাড়ি ভাড়া ২০০৮ সালে হয়ে গেল সাড়ে ছয় হাজার টাকা। ফলে বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় ছোট বাসায় উঠলাম।

রাজধানীর বনশ্রীর আরেক বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, ২০০৩ সালে আমি আমার স্ত্রী নিয়ে গোপীবাগ থাকতাম। জিনিসপত্রের দাম তখনো খুব বেশি ছিল না। আমার বেতন ছিল তখন সাত হাজার টাকা। বাসা ভাড়া ছিল আড়াই হাজার টাকা। বাড়িতে প্রতি মাসে পাঠাতাম এক হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে বেশ ভালোভাবে মাস চলে যেত আমাদের দুইজনের। এমনকি কিছু টাকা হাতেও থাকত কোনো কোনো মাসে। গোপীবাগ রেললাইনের পাশে বাজার করতাম। ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজিতে ভালোমানের চাল পাওয়া যেত। দুই টাকায় বিভিন্ন ধরনের শাকের আঁটি পাওয়া যেত যা এখন ১৫ থেকে ২০ টাকা লাগে। অন্যান্য সবজির দামও খুব কম ছিল। কিন্তু সস্তার সেই দিন হঠাৎ করে হারিয়ে গেল ২০০৬ সালের পর থেকে। সেই যে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে লাগল তারপর আর কোনো দিন তেমন কমল না জিনিসপত্রের দাম।
জাকির হোসেন বলেন, আমরা আমাদের মা-বাবার কাছে অনেক শুনতাম তাদের সময় জিনিসপত্রের দাম কত সস্তা ছিল। সেসব শুনলে আমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হতো সেই ছোট বেলায়ই। কিন্তু আমরা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে দেখলাম তাতে আমাদের কাছেও এখন রূপকথার মতো মনে হয় আমাদের দেখা ১৫-২০ বছর আগের কথা মনে হলে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/373363