১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩০

বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় কড়া নজরদারি গার্মেন্ট শিল্পে

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় দেশের তৈরী পোশাক কারখানাগুলোর ওপর কড়া নজরদারি আরোপ করেছে সরকার। শিল্প পুলিশের পাশাপাশি শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় নজরদারি বাড়িয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য এসেছে, চলতি মাসের শুরু থেকে কার্যকর হওয়া নতুন মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়ন নিয়ে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে কোনো ধরনের শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হলে সেটি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

বিভিন্ন পর্যায়ের মালিক-শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে দেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাত। বাড়তি খরচের চাপে রফতানি বাণিজ্যে ৮৮ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী এ খাতের উদ্যোক্তারা ভালো নেই। ৪৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এ খাতের জন্য নির্ধারিত নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে শ্রমিকদের মধ্যেও। ৮১ শতাংশ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা ৮০০০ টাকার ন্যূনতম মজুরি কার্যকর হচ্ছে আগামী পয়লা নভেম্বর থেকে। বাড়তি চাপ সামলাতে এরই মধ্যে শ্রমিক ছাঁটাই করতে শুরু করেছেন অনেক উদ্যোক্তা। তৈরী পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবি, দেশের শ্রমঘন এই শিল্পখাত এমনিতেই বৈশ্বিক নানামুখী চাপে রয়েছে। চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গত চার বছরে বন্ধ হয়ে গেছে এক হাজার ২০০ কারখানা। এমন পরিস্থিতিতে নতুন মজুরি কাঠামো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্প পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এমনিতেই শ্রমিকদের সাথে মালিকপক্ষের নানা বিষয়ে মতানৈক্য আছে। তার ওপর শ্রমিক সংগঠনগুলো নানাভাবে তৎপর রয়েছে। কেউ কেউ আবার অপতৎপরতার সাথেও যুক্ত। নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো পক্ষ যাতে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়াতে না পারে সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সক্রিয় রয়েছে। শিল্প পুলিশও তার নিয়মিত রুটিন কাজের পাশাপাশি নির্বাচনের দিকটা মাথায় রেখে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে বলে জানান তিনি।

আশঙ্কার ব্যাখ্যা করে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শত প্রতিকূলতায় থেকেও গত বছরের শেষার্ধ্বে শ্রমিক ভাই-বোনদের কল্যাণের কথা ভেবে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে আমরা নিজ-উদ্যোগে মজুরি বোর্ড গঠনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম এবং বিজিএমইএর প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের শুরুতে মজুরি বোর্ড গঠন হয় এবং শ্রমিকবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনায় পোশাক শিল্পের জন্য নি¤œতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারিত হয়। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকের মূল্য কমেছে, খরচ বেড়েছে এবং বর্তমান পোশাক শিল্পের বাস্তবতায় এই মজুরি বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তারপরও আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পোশাক শিল্পে আট হাজার টাকা নি¤œতম মজুরি মেনে নিয়েছি। ২০১৩ সালেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা নি¤œতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করেছি। তারও আগে ২০১০ সালে নি¤œতম মজুরি তিন হাজার টাকা করেছিলাম। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পোশাক শিল্পে মজুরি বৃদ্ধির হার হচ্ছে ৩৮১.৩৫ শতাংশ।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ২০১৪-২০১৮ সময়ে আমাদের অন্যতম প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকের দরপতন হয়েছে ১১.৭২ শতাংশ। অন্য দিকে, এ সময়ে পোশাকের গড় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৯.৫৪ শতাংশ। ২০১৩ পরবর্তী সময়ে রিমেডিয়েশন বাবদ কারখানাগুলোতে ৫-২০ কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে, যার অর্থায়ন করতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছরই নিয়মিতভাবে ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ হারে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় তহবিল কার্যকর করা হচ্ছে, যা শ্রমিকদের নানামুখী কল্যাণে ব্যয় করা হয়। এই তহবিলের অর্থ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে কোনো অবস্থাতেই পরিস্থিতি নিরাপদ বলে নিশ্চিত হতে পারছি না।

এ দিকে ডিসেম্বর মাসজুড়ে সারা দেশে চলছে নির্বাচনী ডামাঢোল। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্রই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নির্বাচন। ভোটপাগল জাতি এটিকে নিয়েছে উৎসব হিসেবে। তবে একাদশ এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠারও কমতি নেই। উৎসুক মানুষের প্রথম প্রশ্ন, নির্বাচন কি হবে? পরস্পরের কাছে জানতে চাচ্ছেন, কী হতে যাচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে? সুষ্ঠু নির্বাচন হবে তো? এ জাতীয় হাজারো প্রশ্নের চাপে জর্জরিত পুরো দেশ। মাধ্যখানে পড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থা অর্থনীতির। নির্বাচনকে ঘিরে ধীর হয়ে গেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি।
বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পপতির সাথে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তার কারণে দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের মন্দাভাব বিরাজ করছে। নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চিতার কারণে নতুন বিনিয়োগে ধীরগতি বেশ কিছুদিন থেকেই। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই স্থবির হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশেষ করে কেউ নতুন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। পুরনো ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার জন্যও নেই বিশেষ উদ্যোগ। একটু বড় লেনদেনের ক্ষেত্রেও বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে নির্বাচন। অনিবার্য কাজ না হলে বাইরে যেতেও রাজি নন এক শ্রেণীর মানুষ। সবাই অপক্ষো করছেন নির্বাচনের জন্য।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/373365