একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ছবি: যুগান্তর
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৭

দেশপ্রেমের চশমা

ব্যতিক্রমী নির্বাচনে অভিনব প্রচারণা

অংশগ্রহণবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনের পাঁচ বছর পর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে একাদশ সংসদ নির্বাচন। এবার নির্বাচনটির অংশগ্রহণমূলক হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। এবারের নির্বাচনটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এই প্রথমবার সংসদ না ভেঙে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কর্তৃক গঠিত ইসির অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদ না ভাঙায় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপিগণ নিজ পদে থেকে নির্বাচন করছেন। ফলে ইসি চাইলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারবে না।
একদিকে নির্বাচনের অনেক আগে থেকে সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীগণ সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের জনসভায় দলীয় প্রতীকে ভোট চেয়েছেন; অন্যদিকে ওই সময় মাঠের বিরোধীদলীয় নেতারা হামলা-মামলায় নাস্তানাবুদ হয়ে কারাগার ও আদালতে সময় কাটিয়েছেন।
একদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন; অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী জামিন না পেয়ে নির্জন কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। একদিকে সরকারদলীয় নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীরা নির্ভয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন; অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা তাদের প্রচারণায় বাধাপ্রাপ্ত ও আক্রান্ত হচ্ছেন।
তাদের ওপর প্রতিপক্ষের আক্রমণ হলে পুলিশ নীরব থাকছে। ফলে ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করতে পারেনি। মন্ত্রীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন পুলিশি প্রহরায়, আর বিরোধীদলীয় নেতাদের প্রচারণায় থাকছে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক।
দেশের জনপ্রিয় দুই ক্রিকেটার সাকিব ও তামিমের টেস্ট ও ওডিআই মিলে যেখানে সেঞ্চুরির সংখ্যা যথাক্রমে ১২ ও ১৭, সেখানে রাজনীতির মাঠের খেলায় বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের অধিকাংশই ‘হয়রানিমূলক’, ‘ভাংচুর’ এবং গায়েবি মামলার সেঞ্চুরিয়ান। তারা আদালতে হাজিরা দেবেন নাকি নির্বাচনে প্রচারণা চালাবেন সে ভাবনায় দোদুল্যমান।
এ কারণে যেভাবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা ও মিছিল পরিলক্ষিত হচ্ছে, ধানের শীষের প্রার্থীদের পক্ষে ততটা প্রচারণা ও মিছিল দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির প্রচারণা মিছিলে সরকারি দলের প্রচারণা মিছিলের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে গ্রেফতার আতঙ্কে জনসমাগম হচ্ছে কম। এ জন্য ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা জনগণের সহানুভূতি পাচ্ছেন।
নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রথম তিন দিনের প্রচারণায় আশঙ্কাজনক পরিমাণে সহিংসতা, ভাংচুর এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিয়ে ইসি হতাশা প্রকাশ করেছে। সিইসি বিব্রত হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন যে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না, তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। কারণ, এ দেশে তিনটি (৫ম, ৭ম, ও ৮ম) গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রথমে যে দুটি কাজ গুরুত্ব দিয়ে করেছিল, বর্তমান সরকার বা কমিশন সে দুটি কাজে মনোযোগ দেয়নি।

এর একটি হল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অন্যটি প্রশাসনিক রদবদল। সরকার এমন উদ্যোগ নেবে না। কারণ, সরকার নিজেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল। কাজেই সরকার কেন নির্বাচনী আনুকূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের মনমতো সাজানো প্রশাসনের বাগানে রদবদল ঘটাবে?
আগের গ্রহণযোগ্য ৫ম, ৭ম ও ৮ম সংসদ নির্বাচনে সরকার এমন রদবদল করতে পেরেছিল। কারণ, ওই সরকারগুলোর নিজস্ব দল ছিল না এবং তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। সে জন্য অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে ক্ষমতাসীন সরকারের মনমতো সাজানো প্রশাসনিক সেটআপ তারা তছনছ করে দিয়েছিল।
বর্তমান সরকারি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় এমন রদবদল করছে না, পক্ষান্তরে ইসিও যাতে এমনটা না করে সে ব্যাপারে পরোক্ষভাবে কমিশনকে প্রভাবিত করছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ইতিমধ্যে ইসি কমিশনার রফিকুল ইসলাম একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রদত্ত বক্তৃতায় বলেছেন, তারা প্রশাসনিক রদবদলে আগ্রহী নন।
অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে ইসি চাইলে প্রশাসনিক রদবদল করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারত। কিন্তু ইসি তা করেনি। অন্যদিকে, বর্তমান সরকার ও এই ইসির আমলে অনুষ্ঠিত চার রকম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়নি। ওই অস্ত্রবাজদের শাস্তিও দেয়া হয়নি।
ফলে সেই একই সরকার, ইসি ও সংসদ বহাল থাকায় প্রশ্রয় পাওয়া ওই অস্ত্রধারীরা সংসদ নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করতে ভয় পাবে না। ইতঃপূর্বে অনুষ্ঠিত ভালো নির্বাচনগুলোতে দলনিরপেক্ষ সরকার নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের বুকে কাঁপন ধরাতে পেরেছিল।
কিন্তু বর্তমান ইসিকে এ ব্যাপারে আগ্রহী মনে হচ্ছে না। ফলে অবৈধ অস্ত্রধারীরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পরোক্ষ প্রশ্রয় পাচ্ছে।
আরেক দিক দিয়ে ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিতে ব্যত্যয় সৃষ্টি করেছে। সরকারি দল ছাড়া অন্য দলগুলোর পরামর্শ উপেক্ষা করে ইসি কয়েকটি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতঃপূর্বে একজন ইসি কমিশনার বলেছিলেন, ইভিএমে ভোট গ্রহণ করলে অর্থের সাশ্রয় হবে।
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে দুই লাখ টাকা দরে একেকটি ইভিএম কিনে একগুঁয়েমি করে মাত্র কয়েকটি নির্বাচনী আসনে মেশিনে ভোট করার সিদ্ধান্তকে ভোটাররা মন্দ দৃষ্টান্ত বিবেচনা করছেন। সেই সঙ্গে কমিশনকে বলতে চাই, সংসদ নির্বাচন ইভিএমের সক্ষমতা এক্সপেরিমেন্ট করার জায়গা নয়; ইসিও অর্থ সাশ্রয়কারী প্রতিষ্ঠান নয়।

অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যত টাকা লাগে ইসি খরচ করতে পারে, তাতে নাগরিক সমাজ আপত্তি করবে না। কিন্তু ইভিএমকে হ্যাকপ্রুফ প্রমাণ না করে এবং এর প্রতি গণআস্থা তৈরির আগেই ৬টি নির্বাচনী এলাকায় ইভিএমে ভোট না করলেই ভালো হতো। এই ইসি ২০১৭ সালে দায়িত্বে আসার পর সংসদ নির্বাচন ইভিএমে না করার কথা বলেছিল।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপেরও এরা একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন নির্বাচনের প্রাক্কালে হঠাৎ করে কেন ইসি পূর্ব-প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এলো, অনুসন্ধানী সংবাদিক ও নির্বাচন গবেষকদের সে রহস্য উন্মোচন করতে হবে।
নির্বাচনী প্রচারণায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরকারি দলের মতো একইরকম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। সরকারি দলের তুলনায় বিএনপির অনেক বেশিসংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তাদের ওপর চলছে হুমকি-ধমকি, গ্রেফতার ও পুলিশি নির্যাতন।
কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এতসব বৈষম্যের মধ্যেও যে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ না ছাড়ার ব্যাপারে অনড়, এটা বুঝতে পেরে সরকারি দল শঙ্কিত। এ কারণে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের নির্বাচনী মিছিলে আক্রমণ করে এবং তাদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি করে তাদের নির্বচনের মাঠছাড়া করার অঘোষিত পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা দৃশ্যমান।
তা না হলে বিএনপির ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মইন খানের মতো প্রথম সারির নেতাদের নির্বাচনী মিছিল আক্রান্ত হবে কেন?

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল, প্রার্থী ও তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিরাপত্তা দিতে ইসি সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এই নিরাপত্তা সরকারের কাছে পাওয়া যাবে না। কারণ, সংসদ না ভেঙে দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন হওয়ায় এবং সরকারি দল নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় স্বদলীয় স্বার্থে কাজ করবে।
কাজেই এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে অবাধ করতে ইসির বাড়তি সতর্কতা ও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু প্রতীক বরাদ্দের পর প্রথম ৩ দিনে ইসি প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের নির্বাচনী প্রচারণায় সন্ত্রাসী আক্রমণ ও গাড়ি ভাংচুর করা হয়।
সিইসি এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে দুঃখ প্রকাশ ও বিব্রত বোধ করে পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসীদের উৎসাহ দিয়েছেন। গণমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণায় আক্রমণের খবরগুলোর প্রায় ৮০ ভাগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। গ্রেফতার, হুমকি-ধমকি, গায়েবি মামলার ক্ষেত্রেও বিএনপি নেতারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সরকারদলীয় প্রার্থীরা আক্রমণ, মামলা বা গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন এমন সংবাদ চোখে পড়ে না। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকার মধ্য দিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচন হলে তা কারও জন্য ভালো হবে না।
সে ক্ষেত্রে ‘দলীয় সরকারাধীনেও ভালো নির্বাচন হতে পারে’ বলে এতদিন সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীরা যে দাবি করছিলেন, তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। স্বীকৃত হবে অবাধ নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা।

সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা ‘গণতন্ত্র’কে শক্তিশালী না করে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে জনগণের বিরাগভাজন হয়েছে। তাছাড়া একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সবাইকে খুশি করতে পারে না। মানুষ ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তখন সরকারের পরিবর্তন চান।
নির্যাতন করে সবসময় জনগণের দাবি দমিয়ে রাখা যায় না। তবে জনগণই ক্ষমতার মালিক। তারাই ‘কিং মেকার’। জনগণ চাইলে একতাবদ্ধ হয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এ বিষয়ে গভীরভাবে বিশ্বাসী মনে হচ্ছে।
এ জন্য ঐক্যফ্রন্ট থেকে বারবার জনগণকে রাষ্ট্রের ও ক্ষমতার মালিকানা বুঝে নিতে তাগিদ দিয়ে নির্বাচনে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তাদের মনে হচ্ছে, যতই নির্বাচন কাছে আসছে, নির্যাতন বাড়লেও জনগণ ততই তাদের পক্ষে রাজপথে নামছেন।
এভাবে ভোটের দিন জনগণ যদি ফুঁসে উঠে সবাই ভোট কেন্দ্রে যান, তাহলে তারা ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়ে তাদের মনমতো সরকার গঠন করতে পারবেন। ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন এ জন্য বারবার জনগণকে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়ার এবং সেখানে কাউকে ‘দুই নম্বরি’ করতে না দিতে উদ্যোগী হতে বলছেন।
সরকারি নির্যাতনে নির্বাচনের মাঠ ছাড়ার ফাঁদে পা না দেয়ায় সরকারি দলের চেয়ে ঐক্যফ্রন্টকে এ ব্যতিক্রমী নির্বাচনের অভিনব প্রচারণায় যথেষ্ট কৌশলী মনে হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/123144