১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৪

একমাত্র জনগণই দেশকে রক্ষা করতে পারে

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসীল অনুযায়ী আগামী ৩০ শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের ৪০,১৯৯টি কেন্দ্রে ১০ কোটি ৪২ লক্ষ ভোটার তাদের ভোটে পার্লামেন্টের ৩০০ প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা রয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অস্ত্র ক্ষমতার জোরে প্রহসনের মাধ্যমে ভোটার বিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করে। আওয়ামী লীগ জোট ছাড়া ঐ নির্বাচনে কোন প্রার্থী ছিল না। এই দৃষ্টিকোন থেকে গত ২৭ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান তুলে দেয়। শুধু তাই নয় তারা তাদের দলীয় সরকারের অধীনে পার্লামেন্ট বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধি প্রচলন করে যা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলটির নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে সিডিউল ঘোষণার আগ থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে বেং সিডিউল ঘোষণার পর দেশব্যাপী হামলা মামলা ও গ্রেফতার নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অবরুদ্ধ করে এককভাবে নির্বাচনী মাঠ দখল করে আছে। এমন দিন নেই যে দিন বিরোধী দলের প্রার্থী অথবা তাদের এজেন্ট এবং কর্মী সমর্থকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। সারা দেশ একটি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। তেইশ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেলে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে আসার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। বিএনপি মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতা এবং নির্বাচন প্রার্থীদের নির্বাচনী সমাবেশ ও গাড়ি বহরে হামলা করা হয়েছ। দলটির একজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং নির্বাচন প্রার্থীকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলী করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যজোট প্রধান ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের গাড়িতে হামলা করা হয়েছে। ঐক্যজোট নেতা আসম আবদুর রবের গাড়িতে হামলা হয়েছে। এই অবস্থায় দেশে আদৌ নির্বাচন হয় কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ জাময়াতে ইসলামী হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সব চেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত দল। তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় এই দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদেরকে যথাযথ আইনের আশ্রয় নিতে দেয়া হয়নি। ফৌজদারি দ-বিধি ও সাক্ষ্য আইন তাদের বেলায় স্থগিত রেখে গাল গল্প নাটক উপন্যাসের চটুল তথ্য এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিবৃতি অনুযায়ী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বিচারকদের উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল একটি দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী দেশের প্রচলিত আইন মেনে স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং তেইশ দলীয় জোটের শরীক হিসেবে এবং এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত নেতাকর্মীরা জাতীয় নির্বাচনেও অংশ গ্রহণ করছে। এতে ক্ষকতাসীনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। দলটির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতানেত্রী এবং বশংবদ সাংবাদিক বুদ্ধিজীবিরা ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি চেষ্টা করছে। তারা জামায়াতকে খুনী ঘাতকের দল এবং স্বাধীনতা বিরোধী বলে আখ্যায়িত করছে। তাদের অপপ্রচারের তীব্রতা সকল রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং নির্বাচন বিধিকে লঙ্ঘন করছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।

আমাদের জানা মতে জামায়াতের তরফ থেকে বহুবার এই অভিযোগ খ-ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে জামায়াত দেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী বা ঘাতকদের কোনও দল নয়। জামায়াতে কোনও খুনী বা ঘাতক নেই। তারা দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। এই দলটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সততা নিষ্ঠা তার অহঙ্কার। জামায়াত নেতাকর্মীরা ষড়যন্ত্র ও প্রতারণায়ও বিশ্বাস করে না। আশির দশকে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে এরশাদের সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন করেছে। নব্বই-এর দশকে আওয়ামী লীগ জামায়াতের নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মূলা নিজেদের কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ করে এবং সংবিধানে এই সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জামায়াতকে নিয়ে যৌথভাবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। গল্পের এখানেই সমাপ্তি নয়। ১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠনের জন্য নির্ধারিত সংখ্যক আসন পায়নি তখন জামায়াতের ১৮ জন এমপির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের জন্য দলটি ৫ জন মন্ত্রীর পদ জামায়াতকে দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে জামায়াতের নিকট দূত পাঠিয়ে ছিল। একইভাবে ১৯৯৬ সালে সংযোগ সম্পর্ক রেখে এক সাথে আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন তারা যা বলছেন, যখন জামায়াতের সাথে কাজ করেছেন অথবা জামায়াতের সহযোগিতা কামনা করেছেন তখন তা বলেননি কেন? তখন কোথায় ছিলেন?
মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে মিথ্যাচার অন্যায় ও অশোভনীয়। এতে ক্ষমতার মসনদ এবং গোটা জাতিই কলঙ্কিত হয়।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৯ সালের মে মাসে এদেশের কতিপয় ইসলামপ্রিয় নাগরিক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলাম তাদের আদর্শ। তারা শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় এদেশে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে কেউ জামায়াতের ওয়েবসাইটে তাদের গঠনতন্ত্র এবং কর্মসূচী দেখতে পারেন। ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে জামায়াত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তারা করেছে এবং প্রতিটি সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বাংলাদেশের এমন কোন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন বা গ্রাম নেই যেখানে জামায়াতের কার্যক্রম নেই। দেশবাসী তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।
১৯৮৬ সালে জামায়াত ৭৬টি সীটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় সংসদে ১০টি আসন লাভ করে। এ বছরই তারা পার্লামেন্টেরী পার্টি গঠন করে এবং রাজনৈতিক দল হিসাবে আইনী স্বীকৃতি পায়। এর আগে দলটি ১৯৭৯ সালে আইডিএল নামে ১৯টি সীটে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৬টি সীট লাভ করে। ১৯৯১ সালে তারা ২২২টি সীটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮টি সীট লাভ করে এবং ৪১ লাখ ২৩ হাজার ৬৫০ ভোট যা ক্যাস্ট ভোটের ১৬.২০%। ২০১৪ সালে ৩০৯ উপজেলায় জামায়াতের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ৯২ হাজার ১২৯। এতে ১১৩টি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তারা ৩৮ লাখ ২১ হাজার ৭০৭ ভোট পান এবং জয়ী হন ৩৬টি চেয়ারম্যান পদে। এই নির্বাচনে ২২৬টি ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে নির্বাচন করে তারা ভোট পান ৯৫ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৪টি এবং জয়ী হন ১২৯টি পদে। প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ক্যাস্ট ভোটের ৪১.৩৯%। একইভাবে তারা ৭৫টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে ৩৬টি পদে বিজয়ী হন। প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ৩৭২টি, যা ক্যাস্ট ভোটের ৩৯.১৬%।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে একথা পরিষ্কার যে, জামায়াত গণবিচ্ছিন্ন, গণবিরোধী কোনও দল নয়। তারা খুনীও নয়, সরকারি অভিযোগ যদি সত্য হতো তাহলে জনগণ তাদের ভোট দেয়া তো দূরের কথা, সহ্যই করত না।

এদেশে খুনি কারা, কাদের হাত রক্তে রঞ্জিত- দেশের মানুষ ভালভাবেই তা জানেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে অবাঙ্গালীদের হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা ও সংসদে তা নিয়ে বড়াই, তারও আগে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ২০০৬ সালে পল্টনে সাপের মত পিটিয়ে মানুষ হত্যা, বিশ্বজিৎ হত্যা, গুম করে মানুষ হত্যা, ক্রসফায়ারে হত্যা প্রভৃতির রেকর্ড তো একমাত্র আওয়ামী লীগেই আছে। কাজেই খুনীও তাদের দলেই। ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার বিরুদ্ধে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের প্রেস কনফারেন্সের কথা জাতি এখনো ভুলেনি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাস চাঁদাবাজী বিষয়ে সংবাদপত্রে অব্যাহতভাবে লিখা হয়েছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে তারা ধ্বংস করেছে। বিচার বিভাগকে তারা অপব্যবহার করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে তারা প্রমাণ করেছে যে, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার যোগ্য নয়। উন্নয়নের নামে জনগণের প্রকৃত চাহিদাকে উপেক্ষা করে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্নীতির যে কালচার তারা চালু করেছে তা দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থ ও ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ খাতে দুর্নীতি সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ছয় লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে। এর প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে সরকার ও সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই অবস্থায় দলটি কর্তৃক পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য ভোট ভিক্ষা করছে। হাত থেকে জনগণই একমাত্র দেশকে রক্ষা করতে পারে। নির্বাচনের দিন ৩০ ডিসেম্বর এর প্রকৃষ্ট সময়।

http://www.dailysangram.com/post/357589