ফাইল ছবি
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, সোমবার, ১০:৫৯

সহিংসতায় উদ্বিগ্ন বিশিষ্টজনরা

ইসির দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই

নির্বাচন কমিশন সক্রিয় না হলে সহিংসতা বাড়বে * যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলো নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি -কমিশনার কবিতা খানম * আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার অধীনে- নির্বাচন কমিশন, না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের -এম হাফিজ উদ্দিন খান * আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখতে ইসি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে -ড. বদিউল আলম মজুমদার


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকে অব্যাহত সহিংস ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন। তারা বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা বেড়ে গেলেও নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
তাদের শঙ্কা, ইসির এই নিষ্ক্রিয়তা সহিংসতাকে আরও উসকে দেবে। আর সহিংসতা বেড়ে গেলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তরায় হতে পারে। তাই এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা মনে করেন, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর ৯১ ধারা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।
আইনে তাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া আছে। কিন্তু তা প্রয়োগ না করলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। এজন্য সব দায় ইসিকে নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা আরও বলেন, এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে বিব্রত কিংবা শুধু দুঃখ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারে না। এমনকি রোববার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের কাছে ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আছে’ বলে যে দাবি করেছেন তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাদের প্রতিক্রিয়ায় যুগান্তরের কাছে রোববার এমন মন্তব্য করেন।
নির্বাচনে সহিংসতা বন্ধে ইসি নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছে বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, নির্বাচনে যে হারে সহিংসতা হচ্ছে তাতে উদ্বেগ বাড়ছে।
এখন পর্যন্ত সহিংসতার যেসব খবর সংবাদপত্রে বেরিয়েছে, সেসবের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে তা চোখে পড়েনি। ইসির এ নিষ্ক্রিয়তা সহিংসতাকে আরও উসকে দেবে। আর সহিংসতা বেড়ে গেলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তরায় হতে পারে। তাই এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে দেরি হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, ১০ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার একদিন পর থেকে সারা দেশে প্রতিদিনই বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর বিশেষ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের ওপর হামলা, মামলা ও গ্রেফতার অব্যাহত আছে।
গোলাগুলির ঘটনা ছাড়াও বেশকিছু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার ওপর হামলার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
সর্বশেষ শনিবার বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব নোয়াখালী-১ আসনের বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের ওপর হামলার ঘটনায় তার ছেলে ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব রোববার কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন।

ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকেও গতকাল একটি প্রতিনিধি দল বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে দিয়ে প্রতিকার চেয়েছে। এ সময় প্রতিনিধি দলের প্রধান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা গুলি চালানো হচ্ছে। পুলিশ ইসির কথা শুনছে না। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ একটা পাপেটে (পুতুল) পরিণত হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। বেশ কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু রোববার পর্যন্ত কোনো তদন্ত প্রতিবেদন কমিশন পায়নি। ওসি, এসপি এবং ডিসির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে পক্ষপাতিত্বের লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরও কমিশন সেভাবে আমলে নিচ্ছে না।
অবশ্য নির্বাচন কমিশন প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে, যে কোনো সহিংস ঘটনা জানার পরপরই তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফৌজদারি অপরাধে মামলা না থাকলে কাউকে গ্রেফতার বা অহেতুক হয়রানি না করতে নির্দেশনা দিয়েছে। সূত্র বলছে, আজ সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশকে এ বিষয়ে কমিশনের তরফ থেকে চিঠি দেয়া হবে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনী প্রচারে সহিংস ঘটনা ঘটলে এবং ফৌজদারি অপরাধ হলে প্রসিডিউর অনুযায়ী পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। আর আমাদের কাছে (কমিশন) যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলো নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি। এছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে আছে। তারাও আচরণবিধি লংঘনের বিষয় দেখছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব পদক্ষেপ নেয়ার পরও আমরা পুলিশের আইজিকে চিঠি দিতে যাচ্ছি। ওই চিঠিতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ও মারামারির ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হবে।

পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ প্রসঙ্গে কবিতা খানম বলেন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কমিশনে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ইসির এ উদ্যোগে সন্তুষ্ট নন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান। তিনি রোববার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার খবর দেখছি, শুনছি।

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও প্রার্থী বা তার সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠছে। এসব বন্ধে নির্বাচন কমিশনের কোনো চিন্তাভাবনা আছে কিনা তা জানি না। তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগও দেখছি না।
সংবিধান ও আইনে তাদের (নির্বাচন কমিশন) যে ক্ষমতা দেয়া আছে তাও প্রয়োগ করতে দেখছি না। এমন পরিস্থিতিতে সবকিছু যোগসাজশে হচ্ছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার অধীনে- নির্বাচন কমিশন নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের?’ নির্বাচনী প্রচার শুরুর কয়েকদিনেই এমন অবস্থা হলে সামনের দিনগুলোতে কী হবে তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা আছে- বলছিলেন হাফিজ উদ্দিন খান।

এদিকে শনিবার নির্বাচন কমিশনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা দাবি করেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে। কারণ সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
সিইসির এ বক্তব্যের বিষয়ে ড. শাহদীন মালিক বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শব্দের বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রতিদিনই অভিযোগ উঠছে, অমুক স্থানে বিরোধী মতের প্রার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে, অমুক স্থানে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে কিংবা প্রচারে বাধা দেয়া হচ্ছে। তাই সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এটাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড- সিইসির মধ্যে এমন ধারণা থাকলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে না।

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে- প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের বিষয়ে সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমি কোথাও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেখছি না। আমি দেখছি একপাক্ষিক প্রচারণা। প্রতিপক্ষ প্রচারে নামলে তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিবেদককে জানান, তফসিল ঘোষণার পর সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের কাজে সহায়তা করা নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব। অর্থাৎ নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে কমিশন যে পদক্ষেপ নেবে তা তারা মানতে বাধ্য। এছাড়া আরপিওর ৯১এ ধারায় কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ধারায় কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করে ওই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সংবিধান ও আইনে ইসিকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এখন তারাই সর্বেসর্বা। আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখতে ইসি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। এমনকি কারও প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারে। এক কথায়, কমিশন এখন রেফারির ভূমিকায় আছে। রেফারি চাইলে কাউকে হলুদ কার্ড দেখাতে পারে, আবার কাউকে লাল কার্ড দেখাতে পারে।
নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন শঙ্কা দেখা দিচ্ছে বিরোধী পক্ষ প্রচার চালাতে পারবে কিনা, ভোটাররা আতঙ্কিত হয়ে পড়ায় ভোট কেন্দ্রে যাবেন কিনা? এমন পরিবেশ থেকে উত্তরণ নির্বাচন কমিশনকেই করতে হবে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/122771