১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, সোমবার, ১০:৫৫

অভিজ্ঞতার আলোকে ৩০ ডিসেম্বরের সম্ভাবনা

আশিকুল হামিদ : পাঠকরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাপারে আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সে কারণে উপলক্ষ পেলেই আমি ইতিহাসের উল্লেখ করি। ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়াই অবশ্য একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না। আমি ইতিহাসের শিক্ষার দিকটিকে প্রাধান্যে আনতে চাই, যাতে এমন ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, যার ফলে পুরো জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
ভূমিকা দীর্ঘ করার পরিবর্তে মূলকথায় আসা যাক। আজকাল যে কোনো দৈনিক ও টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের প্রায় সব খবরই একাদশ সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে ১০ ডিসেম্বর শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক আবার প্রধান শিরোনাম করেছে, ‘ভোটযুদ্ধে ফিরল বাংলাদেশ’। ‘ফিরল’ শব্দটার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে একথা বলতেই শুধু বাকি রাখা হয়েছে যে, দেশে বহুদিন কোনো নির্বাচন তথা ‘ভোটযুদ্ধ’ হয়নি। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, কথাটা একশ’ভাগ সত্য। ২০০১ সালের অক্টোবরের পর আসলেও সংসদসহ জাতীয় পর্যায়ের এমন কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, যাকে ‘ভোটযুদ্ধ’ বলা যায়। সেবার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল।

প্রসঙ্গক্রমে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের কথা উঠতেই পারে। ওই নির্বাচনের পেছনে ছিল আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে পরিচিত এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’ নামের এমন এক সরকার, যে সরকার ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বাতিল করেছিল। ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা সর্বান্তকরণে ‘সমর্থন’ জানালেও সে সরকারই শেখ হাসিনাকে সংসদ ভবন এলাকার একটি বাড়িতে দীর্ঘ ১১ মাস বন্দি করে রেখেছিল। দলটির অন্য অনেক নেতাকেও ‘জেলের ভাত’ খাওয়ানোর পাশাপাশি চরমভাবে নির্যাতনের শিকার বানিয়েছিল। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল শুধু নন, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ‘কারাগারের পাঠশালায়’ বহুকিছু শিখতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এগুলো ঘটনাপ্রবাহের একটি অংশ। এর পরপর ছিল বহুল আলোচিত ‘ডিল’-এর বিভিন্ন পর্ব। এই পর্বগুলো সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে জানিয়েছেন অনেকেই, যাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা নিজেও। দেশের সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য রাজনীতিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও কম জানাননি। প্রথমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পন্ন ‘ডিল’ প্রসঙ্গ সেরে নেয়া যাক। এ বিষয়ে জানাতে হলে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি নিবন্ধের সহায়তা নিতে হবে। তারও আগে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেনেভায় অল ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উল্লেখ করা দরকার। এতে তিনি বলেছিলেন, ১/১১-এর পরবর্তী সরকারের আমলে তাকে নাকি প্রধানমন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সে প্রস্তাবে রাজি হননি। তথ্য হিসেবে এটা অবশ্য নতুন কিছু ছিল না। কারণ, এ ধরনের প্রস্তাব ও সমঝোতা প্রচেষ্টার কথা জেনারেল মইন উ’দের দিনগুলোতে সব সময় বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী তাই বলে ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নিবন্ধে এসব বিষয়ে একবারে বা ধারাবাহিক বর্ণনায় জানাননি। জানিয়েছেন বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু তিনি না জানালে কি হবে, ইতিহাসের কোনো তথ্যই গোপন রাখা যায় না বা গোপন থাকে না বলেই ওই দিনগুলোতে যেমন, তেমনি পরবর্তীকালেও এ সম্পর্কে অনেক তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৯ সালের ৩ জুলাই সংখ্যায় এরকম কিছু তথ্য প্রকাশ করেছিল ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে। জড়িত কয়েকজনের উদ্ধৃতি দিয়ে রচিত এক রিপোর্টে হলিডে লিখেছিল, শেখ হাসিনার প্রতি জেনারেল মইন উ’দের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেছিল ২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। বেগম খালেদা জিয়া দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে অস্বীকার করায় ‘মাইনাস টু ফরমুলার’ বাস্তবায়নসহ রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক ‘খায়েশ’ পূরণ করতে গিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিলেন উদ্দিন সাহেবরা। তখনই তারা শেখ হাসিনার দিকে ‘মৈত্রীর হাত’ বাড়ানোর কৌশল নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের এড়িয়ে তারা একদল সাবেক আমলা ও অরাজনীতিক ব্যক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন। কারণ, নেতারা তখনও শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করে দলের ভেতরে ‘সংস্কার’ করার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন! সাবেক ওই আমলা ও অরাজনীতিক ব্যক্তিদের মাধ্যমেই শেখ হাসিনার সঙ্গে মইন উ’দের একটি ‘ডিল’ বা সমঝোতা হয়েছিল। মইন উ’র নির্দেশে ডিজিএফআই-এর দু’জন ডিজি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার প্রতিটি বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন। তাদের একজন নিজেই নেত্রীর জন্য বিশেষ কারাগারে খাবার নিয়ে গেছেন। তখন হঠাৎ করেই শেখ হাসিনার ‘কদর’ অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

ঘটনাপ্রবাহের সে পর্যায়েই ডিজিএফআই-এর একজন ডিজিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ‘নীতি নির্ধারক’ হিসেবে বর্ণিত সাবেক আমলা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দিনের পর দিন গোপন বৈঠকে অংশ নিতে এবং গভীরভাবে মেলামেশা করতে দেখা গেছে। শেখ হাসিনা ও জেনারেল মইন উ’র মধ্যে ‘দূতিয়ালিতে’ এইচ টি ইমামের প্রত্যক্ষ অবদান সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক তথ্য প্রকাশিতও হয়েছে। এসব তথ্যে জানা গেছে, তার চেষ্টাতেই শেখ হাসিনা ‘মাইনাস’ হওয়ার অশুভ পরিণতি এড়াতে পেরেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের সমগ্র আয়োজনেও এইচ টি ইমাম প্রধান ‘নটরাজের’ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের চারদিন আগে, ২৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমঝোতা বৈঠকের কথা স্মরণ করতেই হবে। সে বৈঠকে জেনারেল মইন উ এবং প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এইচ টি ইমাম। ছিলেন আরেক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদও। সেদিনের সমঝোতার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ অবিশ্বাস্য ‘বিজয়’ অর্জন করে ক্ষমতায় এসেছিল বলে প্রচারণা রয়েছে। একই কারণে এইচ টি ইমামরাও ‘যথোচিত’ পুরস্কার পেয়েছেন- তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জানানো দরকার, এইচটি ইমাম প্রমুখের মাধ্যমে ‘ডিল’ হওয়ার কারণেই ২০০৮ সালের ১১ জুন হঠাৎ এক ‘নির্বাহী আদেশে’ শেখ হাসিনাকে সংসদ ভবনের ‘সাবজেল’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তিনি একই সঙ্গে ১৩টি মামলায় হাজিরা দেয়া থেকেও অব্যাহতি পেয়েছিলেন। রাতারাতি মুক্তি পেয়ে শেখ হাসিনা শুধু আমেরিকার উদ্দেশে উড়ালই দেননি, উড়াল দেয়ার আগে সবাইকে হতভম্ব করে ‘সুধা সদনে’ উদ্দিন সাহেবদের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সভাপতিত্বও করেছিলেন! প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার দীর্ঘ টেলি সংলাপ নিয়েও বাজারে তখন গুঞ্জন উঠেছিল। কারণ, একটির বেশি পাসপোর্ট রাখা আইনসম্মত না হলেও শেখ হাসিনাকে তার তিনটি পাসপোর্টই ফেরৎ দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে মামলার আলামত হিসেবে থানায় আটকে রাখা গাড়িটিও ‘সুধা সদনে’ পৌঁছে গিয়েছিল। সে গাড়িতে চড়েই ১২ জুন সকালে পুলিশ ও র্যা বের প্রহরায় বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
অন্য কিছু তথ্যও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের প্রাক্কালে তার গতিবিধি ছিল আয়েশী ও ঢিলেঢালা। আজ জ্বর তো কাল মাথা ব্যথ্যা করে কোনোভাবে দিন পার করেছিলেন তিনি। অথচ সত্যি ‘ভোটযুদ্ধে’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়োজন বোধ করলে এবং বিজয়ের ব্যাপারে গ্যরান্টি না থাকলে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার মতো কিংবা তার চাইতেও বেশি সফর করতেন, ভাষণ দিয়ে বেড়াতেন। অন্যদিকে সকল ‘ডিল’ বা ‘আয়োজন’ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে শেখ হাসিনার মধ্যে কোনো তাড়া বা উদ্বেগই লক্ষ্য করা যায়নি। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অবিশ্বাস্য ‘বিজয়’ অর্জন করে ক্ষমতায় এসেছিল।

উল্লেখ্য, এ ধরনের প্রচারণা কখনো অস্বীকার করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, অন্য কয়েকটি তথ্যও প্রমাণ করেছে যে, ‘ডিল’ আসলেও হয়েছিল। যেমন জেনারেল মইন উ’কে তো বটেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে ক্ষমতা দখলকারীদের সকলকেও চমৎকার কৌশলে ছাড় দেয়া হয়েছিল। কাউকেই জবাবদিহি করতে বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদ তার স্ত্রী এবং শ্যালক ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার আহমদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রাথমিক দিনগুলোতেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। জেনারেল মইন উ’কে তার পদ থেকে সরানো হয়নি বরং তিনি সেনাপ্রধানের পদে থাকার সময়ই বিদ্রোহের নামে পিলখানায় ৫৭ জন চৌকশ সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জেনারেল মইন উ’কে প্রথমে মিলিটারি পুলিশের প্রহরায় ‘সোশ্যাল ওয়ার্ক’ করার জন্য বিদেশে যেতে দেয়া হয়েছে। সেই থেকে নিয়মিত যাওয়া-আসার মধ্যে রয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মইন উ’কে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বা ‘সেনা সমর্থিত’ সরকারের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ সরকারের নেই। অক্ষরে অক্ষরেই কথা রেখেছে সরকার। এর আসল কারণ যে বহুল আলোচিত সেই ‘ডিল’ সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।

এবার জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা ও অবদান প্রসঙ্গ। পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে এরশাদ খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। এ উদ্দেশ্যে এরশাদ ও শেখ হাসিনার মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। ঘটনাস্থল ছিল লন্ডন। সেবার ঢাকায় ফিরে এরশাদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে তিনি ‘বোন’ ডেকেছেন এবং মহাজোট বিজয়ী হলে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। এ শুধু তার ইচ্ছা নয়, শেখ হাসিনাও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে এরশাদ বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হতে ‘প্রস্তুত’ আছেন!
সাবেক সেনাপ্রধান হিসেবে সুযোগ নিয়ে জেনারেল মইন উ’দের সঙ্গে শেখ হাসিনার ‘ডিল’ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভ’মিকা পালন করলেও এরশাদ অবশ্য রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। তিনি আরেক বৃদ্ধ নেতা জিল্লুর রহমানের কাছে পরাস্থ হয়েছিলেন। সেই দুঃখে অনেক উপলক্ষেই এরশাদ শেখ হাসিনাকে ভয় দেখিয়েছেন। বিশেষ করে পিলখানা হত্যাকান্ডের পর সেনাবাহিনীকে নিয়েও অনেক কথা শুনিয়েছেন তিনি। বেশি মন্ত্রিত্ব না দেয়ার কারণকে অজুহাত বানাতে চেয়েছেন তিনি। কখনো কখনো আবার জাতীয় পার্টির প্রতি চরম অবহেলার বিরুদ্ধে নেতা-কর্মিদের ক্ষোভকে ব্যবহার করে মহাজোট ত্যাগ করার হুমকিও দিয়েছেন এরশাদ। কিন্তু কোনোবারই তাকে বেশি দূর এগোতে দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণটি অবশ্য কৌত’হলোদ্দীপক। শোনা যায়, এরশাদ যখনই এদিক-সেদিক করার চেষ্টা করেছেন তখনই তাকে নাকি তার বিরুদ্ধে চলমান বিভিন্ন মামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যে সব মামলার কোনো কোনোটিতে এরই মধ্যে তিনি জেলের ভাত খেয়ে এসেছেন। সরকারের অনুগ্রহে এখন রয়েছেন জামিনে। সত্যি এদিক-সেদিক করতে চাইলে তাকে যে আবারও জেলের ভাতই খেতে হবে এবং ঘটনাক্রমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে যে জীবনের বাকি বছরগুলো তাকে জেলেই কাটাতে হবে- এসব বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়েই বোঝানো হয়েছে।

এজন্যই এরশাদের পক্ষে কখনো আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বরং বিভিন্ন উপলক্ষে নিজের কষ্টের কথা শুনিয়েছেন। একই কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও এরশাদকে অংশ নিতে হয়েছিল। তিনি এমনকি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের পরিচিতি নিয়ে টিকে থাকতেও বাধ্য হয়েছেন। এরই মধ্যে এ অনুমানও সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টির পক্ষে কোনোদিনই আর আওয়ামী বলয়ের বাইরে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগবিরোধী ভ’মিকা পালন করা সম্ভব হবে না। একই কারণে ২০১৪ সালের চাইতেও অসম্মানজনক ব্যবহার পাওয়ার পরও এরশাদ মহাজোটের অঙ্গ সংগঠন হিসেবেই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন পর্যন্ত প্রথমে তিনশ আসনে প্রার্থী দেয়ার এবং তারপর অন্তত একশ আসনের জন্য দাবি জানানো সত্ত্বেও এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ‘মাত্তরই’ ২৭টি আসন দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরশাদ কোনো নড়াচড়া করার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। তিনি বরং চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন- এরশাদ বিরোধীরা যাকে ‘পলায়ন’ বা কেটে পড়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একই কারণে এবারের ‘ভোটযুদ্ধে’ এরশাদের কোনো ভ’মিকা রাখার সুযোগ নেই বলা যায়।

এদিকে সামনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থাকলেও দেশকে ‘ভোটযুদ্ধে’ ফিরিয়ে এনেছে আসলে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট। দল দুটির মধ্যে জামায়াতের কথা বলতে হবে বিশেষভাবে। কারণ, আইনত নিষিদ্ধ না করা হলেও জামায়াতকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে সর্বাত্মকভাবে। প্রধান নেতাদের ফাঁসীতে ঝোলানোর পাশাপাশি দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও মামলাসহ সকল পন্থাতেই দলটিকে ‘সাইজ’ ও ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এখনো চেষ্টা চলছেই। তার ওপর আবার দলটিকে জোট থেকে বের করে দেয়ার জন্যও চাপ যথেষ্টই দেয়া হয়েছে। কিন্তু একদিকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে জামায়াতের উদারতা ও আত্মত্যাগ এবং অন্যদিকে বিএনপির চমৎকার কৌশলের কারণে জামায়াতকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করা যায়নি। ‘ভোটযুদ্ধ’ও আসলে জামায়াতের কারণেই জমে উঠেছে। গোপনে ও প্রকাশ্যে অনেক বিরোধিতার পরও দলটিকে জোটের তথা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২২টি আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে একটি উন্মুক্ত আসন। অর্থাৎ সব মিলিয়েই এবারের নির্বাচনে জামায়াত প্রধান একটি নির্ধারকের ভ’মিকায় থাকবে। ফলে কথিত ‘ভোটযুদ্ধ’ও জমে উঠবে এবং হয়ে উঠবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
এ পর্যন্ত আসার পর পাঠকরা নিশ্চয়ই সম্ভাব্য ফলাফলের ব্যাপারে আগ্রহী হবেন। অওয়ামী লীগের মতো একটি দলের সরকারের অধীনে যেহেতু অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এবং বিভিন্ন পক্ষপাতমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশনও যেহেতু অনেক আগেই সরকারের ইচ্ছা পূরণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে ফেলেছে সেহেতু ফলাফল সম্পর্কে এখনই কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তা সত্ত্বেও এটুকু অন্তত বলে রাখা যায়, সত্যিই যদি ‘ভোটযুদ্ধ’ হতে পারে এবং ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোট দেয়ার সুযোগ পান তাহলে বেশি আগ্রহী ও আত্মবিশ্বাসীদের জন্য ‘খবর’ থাকবে। সে ‘খবর’ বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের জন্য ‘সুখবর’ নাও হতে পারে!

শেষ করার আগে বিশেষ করে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার কারণ জানানো দরকার। দুটির কোনোটিই আসলে ‘ভোটযুদ্ধ’ ছিল না। দুটি নির্বাচনের মাধ্যমেই আগে থেকে করে রাখা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। সত্যিকারের নির্বাচন তথা ‘ভোটযুদ্ধ’ হয়েছিল ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হচ্ছে, কেউই জানে নাÑ ৩০ ডিসেম্বর আসলে কোন ধরনের ঘটনা ও কর্মকান্ড দেখতে হবে- সেটা সত্যিই ‘ভোটযুদ্ধ’ হবে নাকি আবারও কোনো পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন করতে দেখা যাবে। এভাবে শেষ করার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রার্থীরা শুধু হামলার শিকার হচ্ছেন না, তাদের ওপর গুলিও চালানো হচ্ছে। খুব স্বল্পসংখ্যক প্রার্থীই নির্বিঘেœ প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন। কারাগারেও ঢোকানো হচ্ছে তাদের। এমন অবস্থায় কোনো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব কি না সেকথা পাঠকরা ভেবে দেখতে পারেন।

http://www.dailysangram.com/post/357469