১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১১:১৮

অনুপ্রবেশ : একটি রাজনৈতিক শ্লোগান

বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম পশ্চিমবঙ্গের মতো সীমান্ত রাজ্যগুলোতে অনুপ্রবেশের শ্লোগান ভারতের রাজনীতিকরা তুলতো, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এখন মনে হচ্ছে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীতেও এই উদ্দেশ্য সংক্রোমিত হওয়া শুরু করেছে। ভারতের সেনা প্রধাণ জেনারেল বিপীন রাওয়াত অতি সম্পতি নিরাপত্তা বিষয়ক এক সম্মেলনে বলেছেন, যে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলকে অস্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ থেকে অনুপবেশ ঘটানো হচ্ছে। তিনি পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন। এই অনুপ্রবেশ ঘটানোর কাজে পাকিস্তানকে সহায়তা করছে চীন। জেনারেল রাওয়াতের অভিযোগ ভারতের রাজনীতিকদের শ্লোগানেরই প্রতিধ্বণি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের শ্লোগান ভারতীয় রাজনীতির একটি পুরনো শ্লোগান।

প্রায় ৩৫ বছর (২রা মে, ১৯৮৩) আগে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের অভিযোগ থেকে উদ্ভুত আসামে মুসলিম গণহত্যার স্বরূপ সম্পর্কে লিখেছিলাম, “আসামের নেলি’র সাম্প্রতিক গণহত্যা সাম্প্রদায়িক নয় এ কথা বলে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে চিঠি দিয়ে মিসেস গান্ধী আত্মপ্রতারণা করলেন। আসামে কত মানুষ মরেছে আমরা জানি না। কোনো দিন জানা যাবে তাও বলতে পারি না। কারও মতে নিহতের সংখ্যা হবে ৮ থেকে ১০ হাজার। কেউ বলছেন ৭ হাজার। কেউ আবার বলেছেন সাড়ে তিন হাজার। মৃতের সংখ্যা যাই হোক, তার বড় অংশ সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমান এবং তারাই যে ছিল আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই। ভারতের অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা এ সত্য কথাটা লুকায়নি। লুকানো সম্ভবও ছিল না। আসামের দাংগায় হিন্দু এবং উপজাতিরাও জীবন দিয়েছে অনেক। কিন্তু সবাই জানেন, এসবই পার্শ্বক্রিয়া, মূলক্রিয়া নয়। আশ্চর্যের বিষয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী অবলীলাক্রমে এ সত্যটাকেই অস্বীকার করে গেলেন।”
“অর্থাৎ ইতিহাসের এক জঘন্য হত্যাকান্ডের দায় থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাক-সাফ হতে চাইছেন। কেউ এত বড় জঘন্য অপরাধ করুক, মানুষ নামের কেউ তা কামনা করতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশের সরকার এ জঘন্য অপরাধের দায় থেকে মুক্ত থাকুন, এটা আমরাও চাই। কিন্তু যা নয় তা বলে বাহবা নেয়াটা পরিষ্কারভাবেই আত্মপ্রতারণা। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দাবী এই কারণেই সঙ্গত বলে স্বীকার করে নেয়া যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না সে বিষয়টা ইতঃপূর্বেও আমি এক লেখায় আলোচনা করেছি। এই বিষয়টা নিয়ে পুনরায় আলোচনার ইচ্ছা মোটেই ছিল না। কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে যে ‘সত্য ভাষণ’ পাঠিয়েছেন, তা একবার খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ তার আত্ম-প্রতারণা তার কাছেই থাক, পরিধি তার না বাড়ুক, এটাই কাম্য।”
আমি ইতঃপূর্বে লিখেছিলাম, আসাম থেকে বিদেশী খেদাও আন্দোলনের শুরু ভারতের কংগ্রেস ও বর্ণ হিন্দুদের হাতেই। অসমীয়দের সাথে আসামী মুসলমানদের বিরূপ সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু অতীতে অসমীয়দের কানে মন্ত্র ফুঁকে ওদের সাথে নিয়ে বিদেশী খেদাওয়ের নামে আসাম থেকে মুসলিম খেদাও-এর ‘মহৎ’ উদ্যোগ নিয়েছে বারবার। তাদের এ মানসিকতা এখনও ষোল আনাই বর্তমান। তাদের বড় ক্রোধ আসামের অসমীয় উপজাতিদের উপর। তাদের অভিযোগ, অসমীয়রাই লাই দিয়ে মুসলমানদের মাথায় তুলেছে, তারই ফল নাকি আজকের অবস্থাটা। কলকাতার একটা দৈনিকে জনৈক বীরেন ঘোষ লিখেছিলেন, “........আসামের রাজনীতিতে এই মুসলমানরাই গত কয়েক দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে আসছিল। আসামকে একটি মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা দীর্ঘ দিনের। কখনও অসমীয় মুসলমান, আবার কখনও সয়া অসমীয় নাম দিয়ে এদের বাঙালী হিন্দুদের জব্দ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। .....এই কাজে সাফল্য আনতে ওপার বাংলা ওপার বাংলা থেকে আসা মুসলমানদের অসমীয় ভাষাভাষি হিসাবেই নথিভুক্তকরা হয়েছিল। ....সেই মুসলমানরাই যখন রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করতে উদ্যত হলেন তখনই প্রয়োজন দেখা দিল বিদেশী বিতাড়নের। ....আজ আসামে তথাকথিত বিদেশী বলতে দেশ বিভাগের পর ওপার বাংলা থেকে চলে আসা বাঙালী মুসলমানরাই আক্রমণের লক্ষ্য।”
বীরেন বাবুর এ বক্তব্যের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। তিনি কোনো রাখ-ঢাক না করে মুসলিম বিতাড়ন মানসিকতা সুন্দর করে কাগজের পাতায় রূপ দিয়াছেন। তাঁর বক্তব্যে তিনটি জিনিস পরিষ্কার। এক, অসমীয়দের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কে বরাবরই ভাল ছিল, দুই, মুসলমানরা আসামের রাষ্টক্ষমতা দখল করতে গিয়েই এই বিপত্তি, তিন, মুসলমানরাই অসমীয়দের বিদেশী খেদাও আন্দোলনের লক্ষ্য।
বীরেন বাবুর এ তিনটি কথার মধ্যে প্রথমটির সাথে কোনোই দ্বিমত নেই। সাধারণভাবে অসমীয়দের সাথে আসামী মুসলমানদের সম্পর্ক খুবই ভালো।

কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টি ডাহা মিথ্যা প্রচারণা। আসামে মুসলমানরা কমবেশী শতকরা ২৫ ভাগ, এর উপর তারা তুলনামূলকভাবে সবদিক দিয়েই দুর্বল। সুতরাং তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কথা একটা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে সত্যটা এর সম্পূর্ণই উল্টো। আসল ব্যাপার হলো, আসামে রাজনৈতিক প্রাধান্য অসমীয় বর্ণ হিন্দুদের হাত থেকে নিম্ন বর্ণ ও অসমীয় উপজাতিদের হাতে স্থায়ীভাবে চলে যাবার আশংকা থেকেই বিদেশী খেদাও আন্দোলনের জন্ম। একথাটা আমার নয়। অসমীয় সাংবাদিক হোমেন বরগোহাঞ্চি ২২শে এপ্রিল তারিখে কলকাতার দৈনিক আজকালে পাঠানো এক সমীক্ষামূলক রিপোর্টে বলছেন, “আসামের বিদেশী খেদাও আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। কিন্তু তার অনেকদিন আগে থেকেই ‘আসু’র নেতৃত্বে অসমীয় ছাত্রদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাতে থাকে বিভিন্ন দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে। এটা হয়তো ঠিক কাকতালীয় সংযোগ নাও হতে পারে যে, ১৯৭২ সালে শরৎচন্দ্র সিং মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দিন থেকেই আসুর নেতৃত্বাধীন অসমীয় ছাত্র সমাজ মারমুখো হয়ে ওঠেন। এর একটা প্রধান কারণ অবশ্যই এই ছিল যে, শরৎচন্দ্র সিং মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দিন থেকেই আসামের রাজনীতিতে অসমীয় বর্ণ হিন্দুদের প্রাধান্যের অবসান সূচিত হয় এবং অনুন্নত নিম্নশ্রেণীর জনগোষ্ঠীরা কিছুটা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করনে।” উল্লেখ্য, শরৎচন্দ্র সিং ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত আসামে ক্ষমতাসীন ছিলেন। এরপরই শুরু হয় আসামে নতুন নির্বাচনের ডামাডোল। আর এই সময়ই আসামে বিদেশী খেদাও আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে এবং দাবী তোলা হয় য়ে, বিদেশীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ না দিলে আসামে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। এ থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, মুসলমানদের তাড়িয়ে অসমীয় উপজাতি ও নিম্নশ্রেণীর লোকদের দুর্বল করে আসামের বর্ণ হিন্দুদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল ‘আসু’র বিদেশী খেদাও আন্দোলনের লক্ষ্য।

বীরেন বাবুর তৃতীয় বক্তব্যটিও সত্য। বর্ণহিন্দু প্রভাবিত ‘আসু’র মুসলিম বিতাড়নই ছিল বিদেশী খেদাও আন্দোলনের লক্ষ্য। তবে একথা ডাহা মিথ্যা যে, ১৯৬১ সালের (যে সালকে ‘আসু’ বিদেশী খেদাও-এর ভিত্তি বছর ধরতে চাচ্ছে) পর আসামে নতুন করে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বরং এ সময় আসামে মুসলমানদের প্রকৃতপক্ষে সংখ্যা হ্রাসই পেয়েছে। ভারতীয় এক তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১ সালে মুসলমানদের সংখ্যা যেখানে ছিল মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগ , ৭১-এ তা এসে দাঁড়ায় শতকরা ২৪ ভাগে। কিন্তু এ সত্যটি বর্ণ হিন্দু প্রভাবিত আসামের বিদেশী খেদাও আন্দোলনকারীরা গোপন করে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মজবুত করাই যে এর কারণ তা এখানে পানির মতই পরিষ্কার।
উপরে বীরেন বাবুর তিনটে কথা এ বাস্তবতারই স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, বিদেশী খেদাও আন্দোলনের সে সময়ের মূল হোতা ‘আসু’ বর্ণ হিন্দুদের রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে মুসলানদের বিতাড়ন ও নিধনের পুরানো সেই বারদোলই মঞ্চকেই নতুন করে সাজিয়ে তুলেছিল। এই মঞ্চে ‘ফিনিশিং টাস’ দিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। উপলক্ষ ছিল নির্বাচন। নির্বাচনকে উপলক্ষ করে মিসেস গান্ধী মুসলমানদেরকে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দিলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুসলমানরা সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের কাছে হার মানল। আসামের বর্ণ হিন্দুরা তো এই ভুলের সুযোগ নেবার জন্য প্রস্তুতই ছিল।

অন্য দিকে অসমীয় উপ-জাতিদের বেশীরভাগ ষড়যন্ত্রটা আঁচ করতে পারলো না। দিল্লীর প্রতিভূ হিসেবে ধরে তারাও মার মুারমুখী হলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এরই ফল আসামের গণ-হত্যা। যার প্রধান শিকার হলো মুসলমানরা। আরো যারা মরেছে তারা মূলতঃ ঘটনার ঘূর্ণিঝড় এবং বিদেশী খেদাও আন্দোলনের বহিঃপ্রকৃতির প্রভাব হিসেবেই অহেতুকই আত্মদান করেছে বলা যায়। সুতরাং সবদিকের বিচারে আসামের সাম্প্রতিক গণহত্যা ছিল আসাম থেকে মুসলিম নিধন ও বিতাড়নের একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল। এই জলজ্যান্ত সত্যটাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে প্রেরিত তাঁর চিঠিতে সজ্ঞানভাবে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছেন।
দুই
সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগে ২৫ আগষ্ট, ১৯৮৩ সালে পশ্চিম বঙ্গে অনুপবেশ-শ্লোগান নিয়ে লিখেছিলাম: আসামের মত পশ্চিমবঙ্গেও বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের শ্লোগান ঘোর তুংগে। এই শ্লোগান সৃষ্টি হবার কাহিনীটা মজারই বলতে হবে। বেশ অনেকদিন আগে, যখন এ ধরনের শ্লোগানের নাম-গন্ধও ছিল না, আর এস এস প্রধান বালা সাহেব (উল্লেখ আজ আসামে বাংলাদেশী খেদাও অভিযানের হোতা এই আরএসএস-বিজেপি’রাই) দেওরাজ কলকাতার ‘শহীদৎ মিনার ময়দানে এক জনসভায় প্রথম এই অভিযোগ আনলেন, “ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের অনুপ্রবেশে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিপন্ন হয়ে উঠেছে।” ঐ বক্তৃতায় তিনি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান।
দেওরাজ কলকাতার বাতাসে যে কথার বীজ বপন করে গেলেন তা থেকে গাছ গজিয়ে শীঘ্রই তাতে ফল ধরল। কলকাতার বড় বড় দৈনিক বিশেষ করে মুসলিম বিদ্বেষ কর্মে অগ্রগামী আনন্দ বাজার, যুগান্তর প্রভৃতি পত্রিকা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের প্রশ্ন তুলে তৈ-চৈ শুরু করে দিল। এ কাজে তারা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিরুদ্ধেও যোগসাজশের অভিযোগ নিয়ে এল। কলকাতার একটি দৈনিক লিখল, “একমাত্র চব্বিশ পরগনা সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ বাংলাদেশী পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে।” গোটা সীমান্ত দিয়ে তাদের কথিত অনুপ্রবেশের অংকটাকে তারা কত বড় মনে করে এই একটা অংক থেকেই তা অনুমান করা যায়। এই অনুপ্রবেশের অভিযোগের পাশাপাশি তারা এর সাথে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের যোগসাজশের যে অভিযোগ আসছে তা আরও মারাত্মক। বলা হচ্ছে : “কলকাতা ও তার আশপাশের মুসলিম বস্তিতে বেআইনীভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের। এই কিছু দিন আগেও এই মুসলমানদের বাসস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, অতঃপর বাংলাদেশে। ..... অনুপ্রবেশকারীদের প্রথম আশ্রয় দেয়া হয় মেট্রিয়া বুরুজে। অনুপ্রবেশকারীরা এখানেই জমায়েত হয় প্রথম। অতঃপর কৌশলে তাদের ছড়িয়ে দেয়অ হয় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। ...... বিভিন্ন মুসলিম এলাকা, যেমন গার্ডেনরিচ, মেটিয়া বুরুজ, একবালপুর এবং পার্ক সার্কাসে তাদের আশ্রয় দিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

দেওরাজ এবং কলকাতার পত্র-পত্রিকা মাঠ গরম করার পর দিল্লী সরকার মুখ খুললেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভেংকট সুববাইয়া বললেন, “তার কাছে খবর আছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লোক সীমান্ত পেরিয়ে আসছে। এর জন্য পশ্চিমবঙ্গের লোকসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে তা নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও পাল্টে যাচ্ছে।” এরপর তাঁর প্রতিশ্রুতি : “অনুপ্রবেশ রুখতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কেন্দ্র সমস্ত রকম সাহায্য করবে।”
সব মিলে কাহিনীটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? দেওরাজ হাওয়ার উপর যে অভিযোগ এনেছিলেন, কলকাতার পত্র-পত্রিকা তাকেই বিশ্বাস করাবার কসরত করলো। সবশেষে সরকার এই কসরতকে কবুল করে নিয়ে অনুপ্রবেশের ব্যাপারটাকে শুধু সত্য বলেই ঘোষণা করলেন না তা রুখার জন্য পদক্ষেপের কথাও ঘোষণা করা হলো। এরপর আর বাকি থাকে কি? আজকের আসাম আন্দোলনের শেষ অধ্যায়টা হলো, অনুপ্রবেশকারী বা বিদেশী বলে কথিতদের খেদাও আন্দোলন এবং একে ত্বরান্বিত করার জন্য তাদের উপর গণহত্যা চালানো। পশ্চিমবঙ্গে কাহিনীর এই অংশটুকুই আজ বাকি আছে। বাকি থাকলেও ঘটনা যেন সে পূর্ণতার দিকেই গড়াচ্ছে। খোদ দিল্লী সরকারের কথাতেই এর ইঙ্গিত আছে। কলকাতার আখবার-এ-মাশরিক এর বক্তব্য অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর যা জানিয়েছে তা এই : “স্বরাষ্ট্র দফতর নিজেই জটিল বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। .... সময়মত অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত না হলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে। পশ্চিবঙ্গও আরেকটি আসামে পরিণত হবে।”

এর চেয়ে স্পষ্ট আর কি চাই? আসামের মতই পশ্চিমবঙ্গ অনুপবেশ ঘটছে, ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের লাখ লাখ বসতি কায়েম হয়ে গেছে- হৈ-চৈ বাধিয়ে আসাম-টাইপ কার্যসিদ্ধির জন্য এর ছেয়ে বড় অজুহাত আর কি চাই! বলা যায় একদিক থেকে তাদের আঁকা পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের ছবিটা আসামের ঘটনা থেকেও স্পষ্টতর। আসামে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকররণের জন্য অনেক যাচাই-বাছাই প্রয়োজন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তার কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে অনুপ্রবেশকারীরা বলতে গেলে সাইনবোর্ড টাঙিয়েই বসে আছে। কলকাতার একজন সাংবাদিকের ভাষায়, শুনুন। দৈনিক আজকালের সংবাদদাতা শুভ সংকর ভট্টচার্য লিখেন: “হাবরা থেকে বনগাঁ যেতে যশোহর রোডের উপর সারি সারি ঝুপড়ি দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছিল, এরা কোথা থেকে এলেন? এক বছর আগেও ত এইসব ঝুপড়ির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সামান্য, খোঁজ নিতেই জানা গেল, এগুলো অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীদের ঝুপড়ি। এসব ঝুপড়ির জনাকুড়ি বাসিন্দার কাছে প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর কর্মীদের ঘুষ দিয়ে তারা এদেশে প্রবেশ করে কায়েম হয়ে বসেছেন।” এখন প্রশ্ন হলো, অনুপ্রবেশকারীরা যখন এত পরিচিত, এদের বসতি যখন এত স্পষ্ট, তখন পশ্চিমবঙ্গকে ‘আরেকটি আসামে পরিণত’ হওয়া থেকে রক্ষার জন্য অনুপ্রবেশ রোখার শ্লোগান তুলেই কি ক্ষান্ত থাকা হবে? যুক্তির দাবী তো এটাই যে, এমন ক্ষান্ত থাকার জন্য আট-ঘাট বাধা অনুপ্রবেশের এমন কাহিনী অবশ্যই রচনা করা হয়নি। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে কায়েম হয়ে যাওয়া লাখ লাখ ‘অনুপ্রবেশকারী’দের খেদানোর প্রশ্ন অবশেষে আসছেই। সেই আসার সাথে আসছে দাংগা ও গণহত্যার তান্ডব লীলা। আর আসামের মতই এর কোনো দায়-দায়িত্ব দিল্লী সরকারের উপর বর্তাবে না নিঃসন্দেহে। যুক্তি সেই একই, এই সব ঘটনার ঘটক হলো বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী’রা তথা বাংলাদেশ। সুতরাং মনের সুখেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদেরকে চৌদ্দপুরুষের ভিটে মাটি ছাড়া করতে পারবেন। এ কথাগুলোকে আগাম এবং অবাঞ্ছিত মনে হতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশ্য জনপথের ধারে এবং নির্দিষ্ট সব জনবসতিসমূহে লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারীর বসতি স্থাপনের কাহিনী সৃষ্টির এ ছাড়া আর কি অর্থ আমরা নিতে পরি?

বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ প্রমাণ করতে গিয়ে ভারত থেকে যে সব আহামরি যুক্তি দেখানো হচ্ছে তর পর্যালোচনা আমার আজকের নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। তা না হলে দেখানো যেত, যশোহর রোডের যে সব অনুপ্রবেশকারীর খবর একজন সাংবাদিক এক নিমেষেই জানতে পারেন, জিজ্ঞেস করে ভারতে তাদের ‘কায়েম’ হবার সব খবর ভারতীয় সাংবাদিক ভ্রাতারা উদ্ধার করতে পারেন, সেই সব অনুপ্রবেশকারী ভারতের পুলিশ, বি এস এফ ও গোয়ান্দাদের নজর এড়িয়ে যশোহর রোডে কলকাতার মেটিয়া বুরুজ, একবালপুর, পার্ক সারকাস ইত্যাদি স্থানে ‘কায়েম’ হয়ে যাবার কাহিনীগুলো নিছক আষাড়ে গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এ পর্যালোচনায় আমি যেতে চাই না। পশ্চিমবঙ্গেও কিভাবে আসামের মতই মুসলমানদের ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হচ্ছে কিভাবে তাদে মূলোচ্ছেদ করার একটা পরিকল্পনা ক্রমে পোক্ত করে তোলা হচ্ছে, শুধু তারই কিঞ্চিত পরিচয় তুলে ধরা আমার আজকের এ নিবন্ধের লক্ষ্য।

অনুপ্রবেশের শ্লোগান তোলা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অভিযুক্ত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের একটা কদর্য ছবিও তারা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থ সাধারণ মানুষের বসবাসযোগ্য নয়, এ কথা তারা কৌশলে প্রমাণ করতে চাইছে। সেই সাথে ;আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চরিত্র হননের কাজও তারা করছে। তারা বলতে চাইছে, এদের দেশপ্রেম ও চরিত্র বতৈ কিছু নেই। পাঁচ দশ টাকা হলেই এদের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধকে কেনা যায়। মহাম্মদ কাশেম আলী নামের জনৈক ‘অনুপ্রবেশকারীর’ মুখ দিয়ে একজন ভারতীয় সাংবাদিক লিখছেন, “বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের কোনো কর্মীর হাতে পায়ে ধরে ও তার হাতে পাঁচ টাকা গুঁজে দিয়ে তিনি সীমান্ত পেরিয়েছেন।” আরেক জায়গায় লিখেছেন, “বনগাঁ স্টেশনে পাঁচজন সফল অনুপ্রবেশকারীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এদের একজন বেশ সোল্লাসে বললেন, দস্তুরমত বাংলাদেশের এক সীমান্ত রক্ষীর হাতে পঞ্চাশ টাকা প্রণামী দিয়ে ভারতে কারবার করতে এসেছি।” ভারতীয়দের তরফ থেকে আরও বলা হচ্ছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী অনুপ্রবেশ রোধে অনেকখানিই সফল হতো “যদি বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীদের সহায়তা পাওয়া যেত খানিকটা। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঘটনাক্ষেত্রে সেটা ঘটছে না। দেখা যাচ্ছে পাঁচ, দশ টাকা বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীদের হাতে গুঁজে দিয়ে (অনুপ্রবেশারীরা) এদেশে ঢুকে পড়ছেন।” ঠিক এ রকমেরই কদর্য চিত্র আঁকা হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতির। তাদের মতে এভাবেই খাদ্য ও কাজের সন্ধানে লাখ লাখ অনুপবেশকারী পশ্চিবঙ্গে জমা হয়েছে। এমনকি তারা বলতে চাচ্ছে, ভিক্ষেও বাংলাদেশে মেলে না। সাঈদা খাতুন নামের পঁচিশ বছর বয়সী এক অনুপ্রবেশকারীণিকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, “ভারতবর্ষে মজুরের রেট বেশী। তাছাড়া ভিক্ষে করলেও এদেশে কিছু জোটবার সম্ভাবনা রয়েছে।” ভারতীয় সাংবাদিকদের ভাষায় সাঈদার কাতর উক্তি: “দোতাই বাবুরা! আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমরা মায়ে-পোয়ে কতটুকুই বা ভাত খাব আপনাদের?”
বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য তুলনামূলকভাবে ভারতের চেয়ে কম কি বেশী, বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি ভারতের চেয়ে ভালো কি মন্দ, বাংলাদেশে ভিক্ষা পাওয়া যায় কি যায় না, এ বিতর্কে আমি যেতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই, বাংলাদেশীদের কাছে আজকের অবস্থার তুলনায় ১৯৭৪ সাল ঘোর দুঃস্বপ্নের মতো যখন রাস্তায় রাস্তায় গড়াগড়ি গেছে অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষের হাজারো লাশ। তখন তো বাংলাদেশের মহাম্মদ কাশেম আলী ও সাঈদারা ভারতে লাখে লাখে যায়নি? সাথে আমাদের গলাগলি আরও নিবিড় ছিল তখন! এতদসত্ত্বেও তখন খাদ্যের সন্ধানে দেশ যারা ছাড়েনি, তারা আজ লাখে লাখে সেখানে যাবে কোন দুঃখে?

প্রশ্নটা আমার একান্তই স্বগত। কারো কাছে এর জবাব প্রত্যাশা করি না। কারণ আগেই বলেছি জবাব দেয়া কিংবা জবাব নেয়া আজকের আমার আলোচনার লক্ষ্য নয়। তবে একটা বিষয়ের দিকে ইংগিত করবো, ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি খেলা হয়। ‘৮১ সালের ভারতীয় আদম-শুমারীতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যার কোনো হিসেব দেয়া হয়নি। অর্থাৎ মুসলিম জনসংখ্যার ব্যাপারটা গোপন করা হয়েছে। অতীতেও ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার কোনো সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘে কৃষ্ণ মেনন ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ৭ কোটি বলেছিলেন। ভারতের মরহুম মওলানা হিফজুর রহমান সঙ্গে সঙ্গেই কৃষ্ণ মেননের কথার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা কমপক্ষে ১৫ কোটি। তার অনেক বছর পর মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় মুসলমানদের সংখ্যা আট কোটির কথা বলেন। আর এই সময়ই ভারতের জেদ্দা দূতাবাস থেকে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা জানানো হয়েছে ১০ কোটি। মোটকথা মুসলমানদের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরির খেলা হয়। কারণটা কি? কারণ সন্ধান করতে হলে এই লুকোচুরির সাথে ব্যাপক অনুপ্রবেশের অভিযোগকে মেলাতে হয়। মিলালে দেখা যাবে, মুসলমানদের সঠিক সংখ্যা থাকলে লাখ লাখ কিংবা কোটি কোটি সংখ্যায় অনুপ্রবেশের অভিযোগ প্রমাণ করা ভবিষ্যতে কঠিন হয় এবং আসামের পর আরও আসামের মিছিল সৃষ্টি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং গরজ বালাই।
আজও আবার আসামে ৪০ লাখ মানুষকে বিদেশী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এখানেও সেই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের পুরানো শ্লোগান। বলতেই চাই, এই শ্লোগানকেও অতীতের সেই পুরানো অভ্যাসের প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/357389