১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:২৪

ফোনে আড়িপাতা সংবিধানের লংঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় কী?

গোটা বিশ্বেই ফোনে আড়িপাতা বড় ধরনের অপরাধ। আর এ জন্য শাস্তিও পেতে হয়। বাংলাদেশের আইনেও কারো ফোনে আড়িপাতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য আদান প্রদান ও যোগাযোগকে মৌলিক অধিকারের তালিকায় স্থান দিয়েছে এবং তা সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব দিয়েছে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদক্রমে নির্ধারিত সময়ের জন্য কারো কারো ফোন রেকর্ড করা যায় বলে আইনজ্ঞরা বলছেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ফোনে আড়িপাতার খবর পাওয়া যেত। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে কিছুদিন পরপরই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের টেলিফোন আলাপ ফাঁস হবার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত কয়েক বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ফোন কল, এরপর বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও শমসের মবিন চৌধুরি, সাদেক হোসেন খোকা ও মাহমুদুর রহমান মান্না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গে সাংবাদিক আব্দুর রব মজুমদারের কথোপকথন, মাহি বি চৌধুরি ও মাহমুদুর রহমান মান্না, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী- এরকম বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস হয়েছে।
কিন্তু এসব ফোন আলাপ ফাঁসের উৎস সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য জানা যায় না। কেউ এর দায়-দায়িত্ব নেয় না এবং কারা এসব করছে তাও জানা যায় না। তবে এসব ফোনালাপ ফাঁস করা বা কারো ফোনে আড়িপাতা কতটুকু আইনসিদ্ধ? এ বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলছেন, ফোনে আড়ি পাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট কিছু আইনে উল্লেখ নেই।
এ বিষয়ে গত অক্টোবরে বিবিসি বাংলাকে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশের আইনে অস্পষ্টতা আছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনে একটি ধারা আছে যেখানে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা সংস্থা যদি প্রয়োজন মনে করে, তদন্তের স্বার্থে বা মামলার স্বার্থে হতে পারে, তাহলে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা যে কারো ফোনে আড়ি পাততে পারবে- এমন কোন সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা বা ক্ষমতা দিয়ে কোন আইনি বিধান নেই। বরং উল্টোটা আছে। যেকোন নাগরিকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান।

বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, কারো ফোনে আড়িপাতা সংবিধানের লংঘন। সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য আদান প্রদানের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কেউ তা লংঘন করলে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হবে। আর এ ধরনের অপরাধের জন্য আদালতের আশ্রয় নিয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও আইনের মাধ্যমে আড়িপাতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩ এ বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতারক্ষার অধিকার থাকিবে।’
সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে, শুধু মোবাইল ফোনই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগের গোপনীয়তা সংরক্ষণও করা হয়েছে এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে।
এদিকে ২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন পাস হয়, পরবর্তীতে ২০১০ সালে সেই আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইনে ফোনে আড়ি পাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। তবে, গোয়েন্দা সংস্থা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্ত সংস্থার মতো সরকারি সংস্থাগুলোর বাইরে যে কোন ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এ আইনের ৭১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি অপর দুই জন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়িপাতেন, তাহা হইলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির, এই কাজ হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭ক এর অধীন সরকার হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে না।’
এই আইনের বিশেষ বিধান হিসেবে ধারা ৯৭ক তে বলা হয়েছে, ‘(১) এই আইন বা অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোন টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎ্সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করিতে বাধ্য থাকিবে।
(২) এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে “সরকার” বলিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝাইবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হইবে।

http://www.dailysangram.com/post/357242