সরকারের উন্নয়ন প্রচারণার সহযোগীর ভূমিকায় ব্যাংক মালিক ও কর্মকর্তারা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত দশ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার তথ্য জানানোর পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ তথ্যকে রাবিশ’ বলে অভিহিত করেছেন। সিপিডির তথ্য প্রকাশের তিনদিন পর গত বুধবার আর্থিক খাতের উন্নয়ন প্রচার করতে মাঠে নামেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি)। এ জন্য সংবাদিক সম্মেলন করেন ব্যাংক এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এই প্রচারে গত ১০ বছরের উন্নয়ন তুলে ধরা হয়। এর একদিন পরেই সিপিডির সমালোচনা করে তাদের তথ্যকে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বলে জানিয়েছেন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। সিপিডিকে চাপে রাখতে এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, গত শনিবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমাদের করণীয় কী’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিগত প্রায় এক দশকে ব্যাংক থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে জানানো হয়। ২০০৮-১৭ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ১৪টি ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ খোয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
বৃহস্পতিবার বিএবির ২৫তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সিপিডির তথ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করা হয়।
সভায় বিএবির সদস্যরা বলেন, ব্যাংকিংখাতে উল্লেখিত সময়ে আট লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। গত ১০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও ব্যাপক শিল্পায়ন দেশের প্রবৃদ্ধির হারকে উচ্চমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। দেশের আর্থিকখাত যখন ধারাবাহিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সে সময়ে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন আর্থিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তারা।
তারা বলেন, আর্থিকখাত বিশেষত ব্যাংকিং খাতের মত স্পর্শকাতর খাতকে কোনো দল বা গোষ্ঠির রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের ব্যাংকিং খাতের এ অব্যাহত অগ্রগতি ধরে রাখতে বিএবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ ও দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিকট ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করে।
বিএবির ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. নাজমুল হাসানের সভাপতিত্বে সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএবির ভাইস চেয়ারম্যান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহিদুল আহসান, নির্বাহী কমিটির সদস্য পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. এইচ বি এম ইকবাল, এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুন নেওয়াজ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ, বিএবির রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টারের মেম্বার সেক্রেটারি এ কে এম নুরুল ফজল বুলবুল, মধুমতি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হুমায়ন কবির, এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহিদুল আলমসহ বিএবির সদস্যভুক্ত ব্যাংকের প্রতিনিধিরা।
এরআগে গত বুধবার আর্থিক খাতের উন্নয়ন প্রচারণা চালায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি)। এ লক্ষ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এতে সরকারি-বেসরকারি খাতের ৩০টির বেশি ব্যাংকের এমডি উপস্থিত ছিলেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সংলাপে ব্যাংক খাতের ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য দেওয়ার তিন দিন পরই মাঠে নামেন তাঁরা। তাদের প্রচারে গত ১০ বছরের উন্নয়ন তুলে ধরা হয়।
উন্নয়ন প্রচার নিয়ে এভাবে এমডিদের সাংবাদিক সম্মেলনে আসার ঘটনা এর আগে ঘটেনি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। তবে আয়োজকদের বক্তব্য, সিপিডির সংলাপের প্রতিক্রিয়া জানাতে তাঁরা এই সংবাদ সম্মেলন ডাকেননি এটা কাকতালীয় হতে পারে।
সাংবাদিক সম্মেলনে এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ১০ বছরের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের উন্নতির চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এতে বড় অবদান রাখছে দেশের ব্যাংক খাত। আপনারা এর ভালো দিকগুলো তুলে ধরবেন। জনগণের কাছে ব্যাংক খাত নিয়ে শুধু খারাপ খবরই যায়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ৯ বছরে দেশের ব্যাংকখাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুটপাটের যে তথ্য প্রকাশ করেছে সিপিডি তা রাজনৈতিক। তিনি বলেন, সিপিডি যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা ঠিক নয়। এসব অর্থ থেকে বেশ কিছু টাকা ফেরত আসবে। তাই সিপিডির দাবিকে জাস্ট রাবিশ’ বলে মন্তব্য করেছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিপিডিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে সরকার। তার অংশ হিসাবেই সিপিডির তথ্যের ব্যাপারে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যেই ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন ও মালিকদের সংগঠনদের দিয়ে পাল্টা উন্নয়নের প্রচার চালানো হচ্ছে। কেননা উন্নয়ন প্রচার নিয়ে এভাবে এমডিদের সাংবাদিক সম্মেলনে আসার ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।