১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:১২

বড়চোরদের ‘পুলিশ পুলিশ ভয়’ নেই

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : চোর। একটি ছোটশব্দ। তবে অনেক ঘেন্নার। চোর যেকাজটি করে সেটি চুরি। চৌর্যবৃত্তি। চুরি কারুর পেশা বা বৃত্তি হোক, তা রুচিশীল ও সভ্য-ভব্যের কাম্য নয়। মান, সম্মান ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন কেউ চৌর্যবৃত্তি গ্রহণ করে না। কারণ এ পেশাটি অপরাধমূলক। আইনত দণ্ডনীয় বা শাস্তিযোগ্য। কেউ চুরি করে ধরা পড়লে পাবলিকের হাতে উত্তমমধ্যমসহ পুলিশের প্যাঁদানি প্রায় অবধারিত থাকেই। এরপরও কেউ কেউ চুরি করে। তবে কাজটি যে অনুচিত এবং অপরাধ তা কিন্তু চোর নিজেও বোঝে। বুঝেশুঝেই চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে কেউ কেউ জড়ায়।

চুরি মানে অজ্ঞাতে অন্যের কিছু নিয়ে নেয়া। না বলে মেরে দেয়া। অন্যের হক বা অধিকার বিনষ্ট করা। কারুর মাঠের ফসল রাতের অন্ধকারে কেটে নেয়া, পকেটের টাকা মেরে দেয়া, ঘরের সিঁদকেটে অন্যের গচ্ছিত সম্পদ, সোনাদানা ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ার কাজ চুরি। অন্যের অধিকার নষ্টকরা ন্যায়সঙ্গত কাজ নয় বলেই তা অপরাধ হিসেবে গণ্য। আর অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে এটাই বিচার।
ইসলামের বিধানমতে চোরের শাস্তি হচ্ছে হাত কেটে দেয়া। যেদেশে এ বিধান চালু আছে সেদেশে তেমন চুরি হয় না বললেই চলে। রাস্তায় মূল্যবান জিনিস পড়ে থাকলেও তাতে কেউ হাত লাগায় না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন তা তুলে রেখে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়, যাতে মালিক এসে জিনিসটি ফেরত নিয়ে যায়। আমাদের দেশে এ বিধান নেই বলেই এতো চোর। শুধু কি চোর? ছিনতাইকারী, ডাকাত ও অপহরকেরও ছড়াছড়ি এখানে।

চোর অবশ্য নানা আকার ও প্রকারের থাকে। ছোটচোর। বড়চোর। ছিঁচকেচোর। সিঁদেলচোর। পুকুরচোর। শুধু পুকুর নয়, এখনতো সাগর পর্যন্ত চুরি করে হজম করতে পারে এমন চোরও আছে। অভাবচোর এবং স্বভাবচোরও আছে সমাজে। যেমন: খেতে যে পায় না, ক্ষুধার তাড়নায় যে চুরি করে সে অভাবচোর। আর চুরি করা যার অভ্যাস অর্থাৎ খাওয়াপরার অভাব নেই শুধু স্বভাব বা বদ অভ্যাসে চুরি করে সে হচ্ছে স্বভাবচোর। অভাবচোরের তেমন অপরাধ না হলেও স্বভাবচোর আসলেই অপরাধী। অভাবচোরের অভাব পূরণ হলে সে আর চুরি নাও করতে পারে। তবে স্বভাবচোর চুরি ভোলে না। তার হাজার ধনসম্পদ থাকলেও চুরি সে ছাড়ে না। এরাই আসল চোর। তবে আমাদের দেশে অভাবচোর ও স্বভাবচোরের মধ্য পার্থক্য করা হয় না। ধরা খেলে আর নিস্তার নেই কোনও চোরেরই। আগে উত্তমমধ্যম। তারপর থানাপুলিশ। মনে করা হয় সব চোর সমান। কথায় বলে, ‘চোরেচোরে মাসতুতো ভাই।’ ঐরকম আর কী! তবে অন্য আরেকটি প্রবাদ আছে চোর নিয়ে। সেটা হচ্ছে, ‘চুরিবিদ্যা বড়বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।’ হ্যাঁ, ধরা পড়ে ছোটচোরই। বড়চোর সাধারণত ধরা পড়ে না। আর পুলিশ অনেকসময় বড়চোরের লোমও স্পর্শ করতে পারে না। এছাড়া রহস্যজনক কারণে পুলিশ ও চোরের মধ্যে গোপন আঁতাততো থাকেই। তখন বড়চোরের পোয়াবারো অবস্থা দেখে কে? আর বড়চোরের বুদ্ধিও বড় হয়। অধরা থাকবার অনেক কলাকৌশলই জানা থাকে তাদের। এমনকি এই বড়চোরেরা সাগর চুরি করেও পুলিশের নাগালের বাইরে থেকে যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা চুরি করেও নিরাপদ থাকতে পারে বড়চোরের দল। শুধু তাই নয়, এই চোরেরাই সবাইকে ওঠবস করাতে পারে। এটাকেই বলা যায় ট্র্যাজেডি। কেউ কেউ পলিটিক্সও বলে। এমন পলিটিক্সের কবলে আমরা। অবশ্য আরও অনেকে এর কবলে। চৌর্যবৃত্তির কালো রাজনীতি অনেক ভালোকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বলা যায়, চোররাই এখন পৃথিবীর প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। আর যতো ভালো, সুশীল, সুজন সবাই নিগৃহীত ও নির্যাতিত দেশে দেশে। এমনকি চোরা কালোরাই ভালোদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার দেদার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে পৃথিবীর অনেক দেশে। এমন পরিস্থিতিকে মানবতার বিনাশক সুনামি বললে অত্যুক্তি হয় বলে আমি মনে করি না।

কিয়ামত তথা শেষবিচারের আগে নাকি দুরাচার-দুর্বৃত্তের দুঃশাসন কায়েম হবে। সুশীলরা নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হবে। সমাজকে অরাজকতা গ্রাস করবে। সুশীল ও সজ্জনেরা দলেদলে কারাবন্দী হবে। দুর্বৃত্তায়নের শিকার হবে সাধারণ মানুষ। সত্য বলবার সাহস হারিয়ে ফেলবে সবাই। চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, শঠ, চোগলখোর বুক ফুলিয়ে চলবে রাস্তায়। সুশীল ও সজ্জনরা পালিয়ে বেড়াবে। লুকিয়ে থাকবে। লজ্জায় কথা বলবে না। প্রতিবাদ করবে না অন্যায়ের। আমরা কি কিয়ামতের অধিকাংশ আলামত প্রত্যক্ষ করছি?

চোরের আরেকটা প্রবাদ মনে পড়লো। সেটা হচ্ছে, ‘চোরের ১০ দিন তো গৃহস্থের ১ দিন।’ অর্থাৎ ১০ দিন চুরি করে চোর পালাতে সক্ষম হলেও কোনও না কোনওদিন তাকে ধরা খেতেই হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে বুদ্ধিমান চোর কৌশলও জানে। রাতে চুরি করে পালাবার সময় পাড়ামহল্লার চৌকিদার ও জেগেওঠা লোকজন একযোগে যখন ‘চোর, চোর, চোর----’ বলে চিৎকার করে তাড়া দেয় এবং ধরা পড়বার উপক্রম হলে চালাক চোর নিজেও ‘চোর, চোর, ধরো, ধরো ---’ চিৎকার দেয় এবং জনতার মাঝে মিশে যায়। এটাই বুদ্ধিমান চোরের বাঁঁচবার রাজনীতি। এ রাজনীতি কেবল চোরেরই কৌশল নয়। বড় বড় পুকুরচোর, এমনকি সাগরচোরও ধরা খাবার ভয়ে ‘চোর চোর ----’ বলে হাঁকডাক শুরু করে দিয়ে জনতার কাতারে মিলবার চেষ্টা করে। অন্যদের জোরগলায় চোর, ডাকাত, খুনি, লুটেরা, আগুনসন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করে নিজেরা গা ঢাকতে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। অথচ জনগণ এদের বেশ চেনে। এরা বর্ণচোরা। নিজেদের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে পগার পার হতে এরা দারুণ পটু। এদেরই বলে ‘অঘটন ঘটনপটীয়সূ’। এদের দ্বারা সমাজ, দেশ ও জনগণ বারবার প্রতারিত হয়। দেশের রাজনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থনীতি, ব্যাংকব্যবস্থা সবকিছু জিম্মি। এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
মন্ত্রীরা তাদের নেতা-কর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন। হুঁশিয়ার করাচ্ছেন বারবার। বলছেন, ‘ক্ষমতা হারালে পিঠের চামড়া থাকবে না কারুর। রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে দেশে। লাখ লাখ লোক মারা যাবে।’ কেন, এতো ভয় কীসের? বিএনপি কি তিন তিনবার ক্ষমতায় ছিল না? এখন যারা ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন তাঁরা বেঁচে থাকলেন কেমনে? কোন জাদুবলে?

আসলে ধরা খাবার উপক্রম হলে সবাই এমনই বলে। কথার ভারসাম্য থাকে না। বেশি কথা বললে ভেতরের গলিজ বেরিয়ে পড়ে। গুমোর ফাঁস হয়ে যায়। জনগণ সবই জানে। বোঝেও। কে, কী বলছেন জনগণের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। দেশের উন্নয়নের যখন এতো জোয়ার বইছে, তখন হারাবার ভয়তো থাকবার কথা নয়। তবে কি সাহস হারিয়ে ফেলছেন? না, সাহস হারাবার দরকার নেই। তবে হ্যাঁ, অন্যায়কারীর বুকে ভয় থাকেই। চোর নিজেকে যতোই সাধু ভাবুক, সিনাটান মনে করুক, বুকের ভেতর দুর্বলতা থাকে সারাক্ষণ। মন থেকে পুলিশভীতি কাটে না। এই বুঝি পুলিশ এসে পাকড়াও করলো! এমন আশঙ্কা ব্যস্ত করে রাখে তস্করকে। অনেক সময় যা বলতে হয় না, তাও বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে। না, আমরা এমন কাউকে ভাবতে চাই না। এতো শঙ্কিত হবারও কারণ নেই। তবে পুলিশ যদি 'পলিস' না হয় তা হলে অপরাধী যতো বড় এবং শক্তিধরই হোক, অন্তর থেকে পুলিশভীতি দূরীভূত হবার কথা নয়।

দুটো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন: গত ১০ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ১৪ ব্যাংকের ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এ টাকা জনগণের। কারা এই লুটেরা? এরা কোন দলের কতজন? তারও হিসেব বের করা জরুরি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণের নামে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেবার মতো বড় কোনও চুরি আর আছে নাকি? মজার ব্যাপার হলো, এমন চোরদের কিন্তু পুলিশ তেমন কিছু করে না। করতে পারে না। তাই বড়চোরদের এখন ‘পুলিশ পুলিশ ভয়’ নেই বললেই চলে।

 

http://www.dailysangram.com/post/357266