১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৪

আলোকচিত্রী থেকে কয়েদি

অনেকটা দৈবক্রমেই ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন শহিদুল আলম। রসায়নের ছাত্র আলম ১৯৮০ সালে তার প্রথম ক্যামেরা নিকন এফএম কিনেন তার
এক বন্ধুর জন্য। সেসময় তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভ্রমণে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পরে তার বন্ধু ক্যামেরার দাম না দেয়ায়, তিনি নিজেই সেটা রেখে দেন। টাইম ম্যাগাজিনকে শহিদুল আলম বলেন, এরপর আমি ক্যামেরাটা ব্যবহার শুরু করি। অধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় আমি আবিষ্কার করি, ছবি কত শক্তিশালী হতে পারে। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, আমি ফটোগ্রাফার হবো।

এখন তিনি বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের দাবিতে হওয়া বিক্ষোভের ছবি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া ছাত্র আন্দোলনকে ফ্রেমে বেঁধেছেন তিনি।
এরফলে তিনি মারধর ও গ্রেপ্তারের স্বীকার হয়েছেন। শহিদুল আলমের ক্যারিয়ার শুধু ছবি তোলাতেই আবদ্ধ ছিল না। ১৯৮৯ সালে তিনি এবং নৃতত্ত্ববিদ ও লেখিকা রহনুমা আহমেদ দৃক পিকচার লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় বাংলাদেশি ফটো সাংবাদিকদের তিনি এরশাদ পতনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বলেন, আমরা একটি যুদ্ধে নেমেছিলাম। সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য যুদ্ধ। এর জন্য আমাদের যোদ্ধার প্রয়োজন ছিল। তখন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি বাকস্বাধীনতার পক্ষে একটি আঞ্চলিক প্রচারকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

১৯৯৮ সালে তিনি পাঠশালা নামের একটি পূর্ণাঙ্গ ‘ফটো অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সালে তিনি এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি মেলা ছবি মেলার আয়োজন করেন। ২০০৩ সালে তিনি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি শিল্পকলা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার জিতেছেন। আলমের ছবিগুলো দেশের রাজনীতিকে ঘনিষ্ঠভাবে তুলে ধরে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এক নারীর ভোট প্রদানের ছবি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জীবনের ছন্দকে তুলে এনেছেন তিনি। ‘মাইগ্রেন্ট সোল’ নামের সিরিজে তিনি ভারতের আখচাষিদের থেকে মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারকে ফ্রেমে বেঁধেছেন। গত বছর এমব্রাসিং দ্য অক্টোবর নামের একটি সিরিজের মাধ্যমে তিনি ইসলামোফোবিয়া ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এটি ঢাকার বাইত-উর রউফ মসজিদে প্রদর্শিত হয়েছিল। শহিদুল আলম বলেন, পশ্চিমা ফটো সাংবাদিকরা বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষ ও ক্লিষ্টতার মাধ্যমে উপস্থাপন করে। তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তুলে আনতে ২০০৭ সালে তিনি একটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবন তুলে আনেন। ২০১০ সালে তিনি র্যা পিড একশন ব্যাটালিয়নের (র্যা ব) বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে একটি সিরিজ শুরু করেন। এ হত্যাকা-গুলোকে ‘ক্রসফায়ার’ নামে চালিয়ে দেয়া হয়।

সামাজিক কর্মকা-ের প্রতি এই দায়বদ্ধতাই গত আগস্টে তাকে বিপদে ফেলেছে। দ্রুতগামী একটি বাসের ধাক্কায় ২ ছাত্র নিহত হওয়ার পর ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার ছাত্র নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। অনেক শিক্ষার্থী অস্থায়ী ‘ট্রাফিক স্টপেজ’ তৈরি করে চালকদের লাইসেন্স যাচাই করে দেখেন। এর সঙ্গে যোগ হয় দুর্নীতি, অসমতা ও ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্তি নিয়ে সরকাবিরোধী ক্ষোভ। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। শহিদুল আলম ছাত্রদের এই বিক্ষোভ ফেসবুকে সরাসরি প্রচার করেন। পরে ৫ই আগস্ট আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সশস্ত্র গু-ারা ছাত্রদের ওপর হামলা চালানোর সময় পুলিশ পাশেই নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। সাক্ষাৎকার দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাদা পোশাকধারী পুলিশ শহিদুল আলমকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে খালি পায়ে কোর্টে তোলার সময় শহিদুল অভিযোগ করেন, তাকে মারধর করা হয়েছে। এমনকি তিনি কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতেও পারছিলেন না। মোট ১০৮ দিন তাকে বন্দি করে রাখা হয়।

এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নোয়াম চমস্কি ও অরুন্ধতী রায়ের মতো প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরাও শহিদুলের মুক্তি চেয়ে প্রচারণা করেন। জাতিসংঘ ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট শহিদুলকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানায়।
জেলে থাকা অবস্থাতেই গত অক্টোবরে তিনি লুসি হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ লাভ করেন। পরে ২০শে নভেম্বর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তার জীবন রক্ষার জন্য মানুষের সমর্থনকে কৃতিত্ব দেন।
গত সপ্তাহে কিউবার শিল্পী তানিয়া ব্রুগুয়েরাকে নতুন একটি ‘আর্ট সেন্সরশিপ’ আইনের বিরোধিতা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এই তানিয়া ব্রুগুয়েরা ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে শহিদুল আলমের তোলা ছবিগুলো লন্ডনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলে। এ বিষয়ে শহিদুল বলেন, বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকতা হুমকির মুখে রয়েছে। শিক্ষক, নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী বা সাংবাদিক সবাইকেই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাগাতার তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে সচেষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিরোধীদল ঘেষা সাংবাদিকরা হামলা ও গ্রেপ্তারের স্বীকার হয়েছেন। শহিদুল আলম এখনো রাষ্ট্রবিরোধী গুজব রটানোর দায়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অভিযুক্ত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী, বিরোধীমত দমনে অন্তত ১২০০ বার এই কঠোর আইনটি ব্যবহার করা হয়েছে। অভিজ্ঞ শহিদুল আলম একজন নির্ভীক ফটোজার্নালিস্ট। এ মাসের শেষে যখন বাংলাদেশিরা ভোট দেবেন, তখন তিনি রাস্তায় নামবেন, ছবি তুলবেন ও সরাসরি সম্প্রচার করবেন। তিনি বলেন, আমি একজন সাংবাদিক। আপনার যা করার, আপনি তাই করবেন।
(টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ)


অনেকে এখন চুপ, তাই আমার কণ্ঠস্বর স্পটলাইটে
এদিকে, বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দ্য গার্ডিয়ান্স এন্ড দ্য ওয়ার অন ট্রুথ। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম সাময়িকী ২০১৮ সালে যাদের বছরের আলোচিত চরিত্র বলে বাছাই করেছে তাদের এভাবেই বর্ণনা করেছে। এরা সবাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হওয়া সাংবাদিক। সেই তালিকায় আছেন নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজি। আছেন মিয়ানমারে আটক রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লোন এবং কিয়া সো। আছেন ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা। আরও আছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত ক্যাপিটাল গেজেট পত্রিকার পাঁচ জন।

টাইম ম্যাগাজিন তাদের এই বিশেষ সংখ্যায় আরও যেসব নির্যাতিত সাংবাদিকের কথা উল্লেখ করেছে, তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের শহিদুল আলম। আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া যে আলোকচিত্রীকে বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকমাস মাস বন্দী করে রেখেছিল। টাইম ম্যাগাজিনের এই সম্মাননাকে তিনি কীভাবে দেখছেন? বিবিসির এই প্রশ্নের উত্তরে শহিদুল আলম বলেন, আমার মতো আরও একশো জন যদি আমার মতো কথা জোর গলায় বলতো, তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে সেরকম আলাদাভাবে দেখা হতো না। আমাকে চিহ্নিত করা হতো না বা আমার সঙ্গে বাংলাদেশে যে আচরণ করা হলো, সেটাও হয়তো ঘটতো না।

শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তরুণ শিক্ষার্থীদের এক ব্যাপক আন্দোলনের সময়। তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ এনেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু শহিদুল আলম মনে করেন তাঁকে ধরা হয়েছিল ভিন্নমতের কন্ঠরোধের জন্য। আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেগুলো নতুন নয়। ঘরে ঘরে সবাই বলে। প্রকাশ্যে বলে না। আর আমি যা করছি, তা তো অনেককাল ধরেই করছি। কিন্তু এখন যেহেতু বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, সেখানে আমার ভূমিকাটা হয়তো আরও পরিস্কার হয়ে গেছে। যেহেতু অনেক মানুষ চুপ করে আছে, তখন একটা কন্ঠস্বর অনেক বেশি লাইমলাইটে বা স্পটলাইটে আসে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=149511