১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৮

হিল সঞ্জয় ও ইফতেখারের অভিন্ন যুদ্ধ

সত্য ও ন্যায় ছাড়া মানবিক সমাজ নির্মিত হতে পারে না, উন্নত সভ্যতাও গড়ে উঠতে পারে না। বর্তমান সময়ে এই বিষয়টি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চাতুর্যময় ভাষায় এখনো অনেকে সত্য ও ন্যায়ের কথা উচ্চারণ করে থাকেন, কিন্তু চ্যালেঞ্জ আসলে দূরে সরে যান। মিডিয়া জগতেও এমন বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রসঙ্গে আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে বলা হয়, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সারির গণমাধ্যম সিএনএন আরেকবার দেখিয়ে দিল যে, তারা নিজেরাই ফিলিস্তিন সমস্যায় আক্রান্ত। ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলায় সিএনএন তাদের রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং টেম্পল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক ল্যামন্ট হিলকে বরখাস্ত করেছে। তার অপরাধ ফিলিস্তিনিদের সাথে জাতিসংঘের সংহতি দিবসে তিনি ইসরাইলের দখলদারিত্বের সমালোচনা এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার দলনের বিষয় তুলে ধরেছিলেন। হিল সেদিন বেশ কয়েকটি বিষয়ে যৌক্তিক ও বাস্তবধর্মী তথ্য তুলে ধরেছিলেন তার বক্তৃতায়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলিদের বৈষম্যমূলক আইন, নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার হামলা, জুলুম-নির্যাতন-হত্যাকা-, ফিলিস্তিন বন্দীদের ওপর নির্যাতন, তাদের ব্যাপারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে ইসরাইলি আদালতের অস্বীকৃতি, তাদের অধিকৃত অঞ্চলে আন্দোলন-বিক্ষোভের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি ব্যাপারে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে নিন্দা জানিয়েছে, সেই কথাগুলোই উল্লেখ করেছিলেন মার্ক ল্যামন্ট হিল।

উল্লেখ্য যে, সিএনএন গত বছর ‘ফ্যাক্টস ফার্স্ট’ (সত্য ঘটনাই প্রথম) নামে নতুন একটি স্লোগান ধারণ করেছিল, কিন্তু এ বছরে এসে তারা তাদের সেই স্লোগানে আর অটল থাকতে পারেনি। ইসরাইলপন্থী অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ (এডিএল) হিলের বক্তৃতার সমালোচনা করার পরপরই সিএনএন হিলকে বরখাস্ত করে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, যারা ইসরাইলের অন্যায়ের সমালোচনা করে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলে তাদেরকে ইহুদী বিদ্বেষী আখ্যা দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। হিলকেও ইসরাইলিগোষ্ঠী সেভাবে চিহ্নিত করেছে।
ফিলিস্তিন প্রশ্নে সিএনএন এখন সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু মার্ক ল্যামন্ড হিল নিরাপদ ও সুবিধাবাদের পথ বেছে নেননি। এ কারণে হিল বরখাস্ত হলেন, অন্য কথায় আক্রমণের শিকার হলেন। তাই সত্যনিষ্ঠার কারণে হিলরাই মানুষের কাছে সম্মানিত হবেন এবং তাদের প্রচেষ্টাতেই হয়তো এই সভ্যতা একদিন ন্যায়ের আলোয় উজ্জ্বল হবে।
ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়টা আসলে কোনো ভূগোলে বাঁধা থাকে না। কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম না পেয়ে এক অভিনব প্রতিবাদ করেছেন মহারাষ্ট্রের নাসিকের কৃষক সঞ্জয় শাঠে। মেধাবী এই কৃষক অভিনব প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষি বিপ্লব ও ঘটিয়েছিলেন। আর সেই গল্প শুনিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। প্রশংসাও পেয়েছিলেন তিনি ওবামার কাছ থেকে। সেই শাঠে আবারও উঠে এসেছেন শিরোনামে। এবার অভিনব প্রতিবাদের কারণে। এ বছর তিনি ৭৫০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ৮৪ টাকা। কেজি প্রতি দাম মাত্র এক টাকা ৪০ পয়সা।
কৃষক সঞ্জয় শাঠে বলেন, এবার ফলন ভালোই হয়েছিল। কিন্তু বেচতে গিয়ে আমরা হতাশ হই। স্থানীয় পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি এক টাকা দর দেয় ব্যাপারীরা। শেষ পর্যন্ত এক টাকা ৪০ পয়সা দরে রফা হয়। টানা চার মাস মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমের এই দাম! সামান্য এই কয়টি টাকা দিয়ে আর কী করবো? তাই সিদ্ধান্ত নেয়, প্রধানমন্ত্রীর বিপর্যয় মোকাবেলা তহবিলে পাঠিয়ে দেওয়ার। মানি অর্ডার করতে খরচ হয়েছে আরো ৫৪ টাকা। গত ২৯ নবেম্বর নিফাদ পোস্ট অফিস থেকে ওই মানি অর্ডারটি করা হয়। ঠিকানা ছিল, নরেন্দ্র মোদি, প্রাইম মিনিস্টার অব ইন্ডিয়া।’ সঞ্জয় বলেন, “আমি কোনো রাজনৈতিক দল করিনা। কিন্তু কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে সরকারের উদাসীনতাও বিরূপ মনোভাবে আমি হতাশ, ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত।”

সঞ্জয় তার ৭৫০ কেজি পেঁয়াজের প্রাপ্ত মূল্য এক হাজার ৬৪ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিপর্যয় মোকাবেলা তহবিলে। হিন্দুস্তান টাইমস এ মুদ্রিত এই প্রতিবেদন পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, বিপর্যস্ত এই কৃষকের এখন কী হবে? বিপর্যয় দেখার কি কেউ নেই।’ হতাশা ও ক্ষুব্ধ সঞ্জয় স্পষ্ট করেই বলেছেন, কৃষকদের দুর্দশার ব্যাপারে সরকার উদাসীন। কৃষকতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলায়। ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া তার অধিকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও দুর্বৃত্তরা কৃষিপণ্যের বাজারজাত প্রক্রিয়ায় নানাভাবে লাভবান হলেও কৃষক থেকে যায় বঞ্চিত। এই চিত্র আমাদের উপ-মহাদেশে যেন গা সহা হয়ে গেছে। ফলে হতাশ কৃষকদের মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করতেও দেখা যায়। অথচ সরকার নিজেদের কৃষক বান্ধব বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। সরকার কৃষক-বান্ধব হলে পেঁয়াজের কেজি এক টাকা ৪০ পয়সা হয় কেমন করে? এ ক্ষেত্রে কি সরকারের কিছুই করার নেই?
ন্যায়ের অবর্তমানে অন্যায় হয়, দুর্নীতি হয়- এটা সব দেশের জন্যই সত্য। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, যারা ব্যাংক লুট করেন, যারা উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ তাদের বিরুদ্ধে দুদকের তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার দৃষ্টান্ত নেই। গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ দিবস-২০১৮’ উপলক্ষে টিআইবি কর্তৃক আয়োজিত এক মানববন্ধনে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, জনগণকে বাদ দিয়ে কখনো কোনো দেশে দুর্নীতিকে রোধ করা যায় না। এ কারণে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিশ্বের ৬৩ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছে।

প্রসঙ্গত টিআইবির প্রধান নির্বাহী বলেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দুর্নীতি সহায়ক পরিবেশ রয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও দেখা গেছে একজন শ্রমিক নেতা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। এই সমস্যা সমাধানে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা পালন করা হয়নি। এটা আমাদের জন্য এক উদ্বেগের কারণ। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণকে দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেতন করে তোলা। দুর্নীতি প্রতিরোধে ১০ দফা সুপারিশও করে টিআইবি। ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যাংকিং খাত, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকা প্রয়োজন। তবে দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বর্তায় দুর্নীতি দমন কমিশন, রাজনীতিবিদ ও সরকারের ওপর।
দুর্নীতির পক্ষে তো কেউ কথা বলেন না, সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ উচ্চকণ্ঠ। তাই প্রশ্ন জাগে, এরপরও দুর্নীতি দূর হচ্ছে না কেন? তাহলে কি আমাদের কথা ও কাজে গড়মিল রয়েছে? আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইন সবার জন্য সমান হওয়া প্রয়োজন। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি অনুরাগ ও বিরাগকে প্রশ্রয় দেয়া হয় তাহলে তো দুর্নীতি দূর হবে না। বরং ক্ষমতাবানরা দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে আরও সাহসী হয়ে উঠবেন। এমন বাস্তবতা দূর করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা কি এগিয়ে আসবেন?

http://www.dailysangram.com/post/357055