১২ ডিসেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১১:৩৬

নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই সহিংসতা ॥ নিরব ইসি

# পুলিশের ওপর ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই -বিএনপি
# ভোটের উত্তাপে পরিবেশ যেন উত্তপ্ত না হয় -সিইসি
নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। নোয়াখালীতে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে ও বেশকিছু আহত হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জোটের মূল নেতা মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়ি বহরে হামলা চালানো হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মঈন খান, হাফিজ উদ্দিন, মাহবুব উদ্দিন খোকন ও মির্জা আব্বাসসহ বিভিন্ন নেতারা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে। একদিকে তাদেরকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাদের প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে, অপরদিকে পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছেও লিখিতভাবে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এখনো নিরব ভূমিকা পালন করছে। তাদের অভিযোগের বিষয়ে এখনো কমিশন কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা গেছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ভোটের উত্তাপে পরিবেশ যেন উত্তপ্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দিয়েছেন। সিইসি বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে উত্তাপের এই পরিবেশ যেন উত্তপ্ত না হয়। উত্তপ্ত হয়ে নির্বাচনি পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয়, ব্যাঘাত না ঘটে।

গত দু’দিনে নির্বাচন কমিশনে নিরাপত্তা চেয়ে অভিযোগ করেছেন বিএনপি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিনসহ বিভিন্ন নেতারা। এছাড়াও সাংবাদিক সম্মেলন করে তাদের প্রচারণায় বাধা দেয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার চার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এবং নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের ওপর ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পুলিশ অফিসারকে ট্রান্সফার করতে হবে, যারা অপরাধ করে তাদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার নির্বাচনী এলাকায় কয়েক দিন ধরে গণগ্রেফতার চলছে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে মহড়া দিচ্ছে। পুলিশ এসব অপরাধের কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিএনপি নেতাকর্মীদের অপহরণ ও গুলি করা হয়েছে। আহত হয়ে এসব নেতাকর্মী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তারপরও পুলিশ কোনো মামলা নিচ্ছে না। আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর প্রথম দিন থেকেই চাটখিল-সোনাইমুড়ি এলাকায় পুলিশ আগ্রাসী হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

খোকন বলেন, বিনা কারণে পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। পাশাপাশি, সারাদেশেও পুলিশ গণগ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে। নোয়াখালীর রিটার্নিং কর্মকর্তাকেও এসব অভিযোগের বিষয়ে জানানো হয়েছে। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশ আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে।
পুলিশ কমিশনের কোনো কথা শুনছে না। ইসি গণগ্রেফতার বন্ধ করতে বললেও পুলিশ এসব আমলে নিচ্ছে না। নতুন নতুন মামলায়, মাদক দিয়ে কর্মীদের ফাঁসানো হচ্ছে। চাটখিলের ওসি এক বিএনপি নেতাকে আটক করে তার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই পুলিশের ওপর কমিশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশ, সরকারি অফিসার, আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি ও ফ্রন্টের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন। রিটার্নিং অফিসাররা চেষ্টা করেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় রাখতে পারছেন না। এসব অনিয়ম বন্ধে কমিশনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান মাহবুব উদ্দিন খোকন।
অপরদিকে ভোলা-৩ আসনের ছয়বারের সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ গতকাল নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভোলাসহ সারাদেশের নির্বাচনী পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সন্ত্রাসীদের ভয়ে তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছেন না। নিরীহ নেতাকর্মীদের পথে-ঘাটে ধারালো অস্ত্র নিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। জেলা যুবদলের সভাপতি জামাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সেলিমসহ অনেক সিনিয়র নেতাকে মারধর করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ভোলা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি নুরুনব্বী চৌধুরী শাওন। তিনি এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। অন্যদিকে ধানের শীষে নির্বাচন করছেন মেজর হাফিজ।
মেজর হাফিজ ইসিতে অভিযোগ করে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলার ঘোরতর অবনতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র জমা নেয়া এবং এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কথা থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে নিশ্চুপ বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, তারা (প্রতিপক্ষ) ইতোমধ্যে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপরে ক্রমাগত অত্যাচার-নির্যাতন বেড়ে চলেছে।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার নির্বাচন এলাকায় জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। রাস্তাঘাটে অস্ত্রধারীরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দেখেও দেখছে না। ৩৫ যুবদলকর্মী তাদের হাতে আহত হওয়ার পর উল্টো এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাজধানী থেকে সন্ত্রাসীরা গিয়ে ভোলার সংসদীয় আসনে অবস্থান নিয়েছে। সারাদেশে ভোটাররা যদি কেন্দ্রে যেতে না পারেন সেজন্য ক্ষমতাসীন সরকার দায়ী থাকবে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ভোটের উত্তাপে পরিবেশ যেন উত্তপ্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সিইসি বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে লক্ষ রাখতে হবে উত্তাপের এই পরিবেশ যেন উত্তপ্ত না হয়। উত্তপ্ত হয়ে নির্বাচনি পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয়, ব্যাঘাত না ঘটে।
দিনে দিনে সাধারণ মানুষ ও বিচারকদের মধ্যে একটা অদৃশ্য কৃত্রিম দেয়াল ছিল উল্লেখ করে কে এম হুদা বলেন, বিচারক ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে দেয়াল থাকার প্রয়োজন ছিল না। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সেই দেয়াল আরও কিছুটা শিথিল হবে। মানুষের কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারবেন তারা কি চায়। এ প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত হবে।
তিনি আরও বলেন, বিচারকদের মানুষের সঙ্গে মিশলে কোনও ক্ষতি নেই। মিক্সড আপ হবেন না। আপনার ব্যক্তিত্ব কতটা শক্তিশালী তার ওপর নির্ভর করে আপনি প্রভাবিত হবেন কি হবেন না। আইন, বিবেক আছে, আপনাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব প্রয়োগ করে একটি সুন্দর ও সাবলীল নির্বাচন করতে পারবেন।

জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, আমাদের কাজ শুধু ৩০ তারিখ। সেদিন ভোট হবে। সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা, যেন কোনও সংঘাত না হয়, ভুল বোঝাবুঝি না হয়। সবাই যেন নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলেন, সেটা বুঝিয়ে দেওয়া। আমাদের উদ্দেশ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা। এর জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
তিনি বলেন, একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের আগের দিন ও নির্বাচনের দিন যাতে সংঘাত হয় না। নির্বাচনের পরের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের দিনের চেয়ে বেশি সংঘাত হয় পরের দিন। অতি উৎসাহী লোক ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে এসব হয়ে থাকে। ভোটের পরের দিন মিছিলের কারণে অনেকের মনে আঘাত লাগে, অনেকে কষ্ট পায়। এতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হয়। আপনারা এ বিষয়টি খেয়াল রাখবেন, সজাগ থাকবেন। নির্বাচনি আইনে আছে নির্বাচনের পরের দিন কোনও শোডাউন হবে না। এটা কঠোরভাবে দেখতে হবে।
সিইসি বলেন, কমিশন অত্যন্ত আশাবাদী সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে থাকবে। হাজার হাজার মানুষ থাকবে। সব রাজনৈতিক দল একটি পজেটিভ অ্যাটিটিউড নিয়ে নির্বাচন শুরু করে দিয়েছে। এত বড় নির্বাচনে এখন পর্যন্ত কোনও সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। আপনারা যখন মাঠে যাবেন আর কোনও সংঘাত ঘটবে বলেও মনে করি না। আপনারা সফল ও সার্থক নির্বাচন করবেন বলে আশা রাখি।

http://www.dailysangram.com/post/356896