১১ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২৮

খেলাপি ঋণের করাল গ্রাসে ব্যাংকিং খাত

৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০-৯৪ শতাংশ এবং অন্য ৬টির ২০-৩৪ শতাংশ * প্রথমবারের মতো ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ৫৮ শতাংশ * নয় মাসে বেড়েছে ২৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা

খেলাপি ঋণের করাল গ্রাসে আক্রান্ত হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। গত নয় মাসের (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১টি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ থেকে ৯৪ শতাংশ। আর ২০ থেকে ৩৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিস্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আরও দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকি খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করেছে ৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৭১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ৫৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত জুনে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঋণ বেরিয়ে যাওয়ায় সেগুলো এখন ফেরত আসছে না। ফলে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকসহ যেসব সমস্যা বিভিন্ন ব্যাংকে ছিল, তা এখনও আছে। এর কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। তাই ঋণখেলাপি বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক ১৪ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ৬১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এই ব্যাংক থেকেও জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ওইসব ঋণ এখন আদায় না হওয়ায় খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৮৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৫ দশমিক ১০ শতাংশ। শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ায় তাদের আদায় কমে গেছে।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৪৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭০৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ব্যাংক থেকে ৭০০ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ৯৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। ব্যাংকটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় এখন ঋণ আদায় হচ্ছে না। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরও ৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ থেকে ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৪৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ। একইভাবে সোনালী ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৩৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ৩৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের বিতরণ করা ২২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকার মধ্যে ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ১৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৩ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের ২০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ১৪ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, মেরামত করে ব্যাংক খাত চালানো যাবে না। সংস্কার করতে হবে। আমি তার সঙ্গে একমত। নির্বাচনের পর ব্যাংক খাত সংস্কার করতে হবে। তা না হলে খাতটি বাঁচানো যাবে না। কারণ ইতিমধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে এবং বিপুল অঙ্কের টাকা অনাদায়ী।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এতে আদায় খুবই নগণ্য। ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। অনেকগুলো ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ আদায় করতে পারছে না, আবার তা খেলাপি হিসেবেও চিহ্নিত করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও এতে নজর দিচ্ছে না। তাদের মতে, সব মিলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে। এছাড়া নানা অজুহাতে প্রতি বছরই ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ছাড় দিচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্যও বেরিয়ে আসছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়বে। এরই মধ্যে খেলাপির কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বিদেশেও ব্যাংকিং খাত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির কারণে বিদেশি ব্যাংকে এলসি খুলতে বাড়তি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসার খরচ।

রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির খেলাপি ঋণের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবটি চূড়ান্ত অনুমোদন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। গত জুনে যা ছিল ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। ওই সময়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ। গত জুন শেষে ছিল ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত জুন শেষে যা ছিল ৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের (কৃষি ও রাজশাহী কৃষি) খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/120768