গতকাল রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডির উদ্যোগে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় -সংগ্রাম
১০ ডিসেম্বর ২০১৮, সোমবার, ৯:০৮

ব্যয় বহনের সামর্থ্য না থাকায় অনেক সৎ যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না -সিপিডি

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, নির্বাচনী ব্যয় এখন অনেক যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বাধ্য করছে। নির্বাচনী ব্যয়ই এখন গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিণত হচ্ছে কি-না, সেটা আমাদের বিবেচনা করার সময় হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে শুধু প্রত্যাশার কথা না জানিয়ে বাস্তবায়নের পথ দেখাতেও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, হলফনামায় সম্পদের যে বিবরণ দেয়া হয় তা আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই থেকে যায়। এটাকে দলিল হিসেবে তার সত্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিতে হবে।

গতকাল রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ডিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন’ শীর্ষক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ অভিমত দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় সাংবাদিক সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম খান প্রমুখ। সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনী ব্যয় এখন অনেক যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বাধ্য করছে। নির্বাচনি ইশতেহারে শুধু প্রত্যাশার কথা না জানিয়ে বাস্তবায়নের পথ দেখাতে হবে। নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী আরও গুরুত্ব দিয়ে যাচাই-বাছাই করা উচিত। নির্বাচনি ইশতেহারে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। আর রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে, ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা এবং উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শও দেন তিনি। নির্বাচনী ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনী ব্যয়ের যে ঘোষণা দেয়া হয়, তা পরবর্তীতে পরিবীক্ষণ করার আগ্রহ বা সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে বলে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে মনে হয়নি।
তিনি বলেন, হলফনামায় সম্পদের যে বিবরণ দেয়া হয় তা আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই থেকে যায়। এটাকে দলিল হিসেবে তার সত্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ কেউ নেয় না। নির্বাচন কমিশনের সেই সক্ষমতা না থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেই সক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং এটা তাদের আগ্রহের বিষয় হওয়া উচিত।

ঋণখেলাপির বিষয়ে তিনি বলেন, ঋণখেলাপি হিসেবে যারা ধরা পড়েছেন, তাদের ঋণের পরিমাণ খুব বড় বিষয় না। আমরা প্রকাশ্যভাবে যেটুকু জানি, সেটা হলো- সব থেকে বড় বড় ঋণ গ্রহীতা যারা নির্বাচনে এসেছেন তারা বহু আগেই তাদের ঋণের প্রভাবগুলো অন্যান্য সংযোগ ব্যবহার করে ঋণকে সমন্বয় অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থায় নতুন একটি ঋণ দিয়ে সেই ঋণের অর্থায়ন করে সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছেন। অর্থাৎ লোক দেখানো একটা ব্যবস্থার এর মধ্যে চালু রয়েছে। সেটার প্রকৃত মূল্যায়ন করার জায়গা হয় তো নির্বাচন কমিশন না, সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার যে সমন্বয় থাকার কথা ছিল, সেটা আমরা দেখি না।
দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতির গুণগতমান দ্বিতীয়ভাগে (২০১৪-১৮) এসে প্রথমভাগের তুলনায় পতন ঘটেছে। সামাজিক বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সরকারের নতুন ধরনের নীতি নিয়ে নতুন উদ্যোগে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে উদ্যম, সেই উদ্যমেও আমরা কিছুটা ঘাটতি লক্ষ্য করেছি। এর বড় একটি কারণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে গেছে।
সিপিডির বিশেষ এই ফেলো বলেন, এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী আলোচনায় কোনো অর্থনৈতিক বিষয় আসেনি। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেভাবে আগাচ্ছে, তাতে নির্বাচন কিভাবে হবে? কেমন করে হবে? কারা করবে? কিভাবে করবে? এসব বিষয়ের প্রাধান্য রয়েছে। জীবন-জীবিকার বিষয় কিন্তু এখনো এই নির্বাচনী বিতর্কের মধ্যে স্থান লাভ করেনি। এটি বড় একটি পরিতাপের বিষয়। সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু বিভাজিতভাবে বৈষম্য বেড়েছে। এটা থেকে বের হতে আগামী দিনে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে বৈষম্য কমাতে হবে। এর জন্য আমাদের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থা এবং আয় বৃদ্ধি করতে হবে। এই তিনটি অর্জনের জন্য শ্রমঘন শিল্প লাগবে।

মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কর-জিডিপির হার কমেছে। ২০১৪ সালে কর-জিডিপির হার ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। এই কর-জিডিপির হার কমার অন্যতম কারণ করবহির্ভূত রাজস্ব কমে যাওয়া। ২০১৪ সালে কর বহির্ভূত রাজস্ব ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২০ শতাংশ।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে রাজস্ব আয় বাড়ার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট ব্যক্তব্য দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজস্ব সংশ্লিষ্ট আইনগুলো অনেকদিন ধরে হয়ে আছে। কিন্তু এগুলো আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছি না। প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবায়নের হার কমছে। ২০১৪ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৮১ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা কমে ২০১৭ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।

তিনি বলেন, বৈদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে ঋণ পরিশোধ করতে আবার ঋণ নিতে হবে এমন দুষ্ট চক্রে আমরা পড়ে না যাই। ১৯৯৯ সালের পর ২০১৭-১৮ সালে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট প্রথমবারের মতো ঋণাত্মক হয়ে গেছে। আমাদের ফিন্যন্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ৫ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত না থাকলে এটা আরও নীচের দিকে টানতো। এটা থেকে দুটি ম্যাসেজ যাচ্ছে। একটা হলো আমদানি বাড়ার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। অন্য বছরগুলোতে প্রবাসীদের আয় দিয়ে সেবা খাতের ঘাটতিটা সমন্বয় করা যেত। এখন ট্রেড অ্যাকাউন্টে ঘাটতি এতো বেশি তা প্রবাসী আয় দিয়ে ব্যালেন্স করা যাচ্ছে না। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে রফতানি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এনে আয় বাড়াতে হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/356637