৯ ডিসেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১২:০৭

বছরে গড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হচ্ছে

ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় গত সাত বছরে ব্যাংক খাতে গড়ে ৭৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণখেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর ব্যাংকগুলোতে গড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা নতুন ঋণখেলাপি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণ অবলোপন আছে আরও প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে এখন প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলা বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোয় সুশাসনের ঘাটতির কারণে অসৎ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা জনগণের আমানতের অর্থ তছরুপ করছেন। ব্যাংক খাতে যতদিন সুশাসন আসবে না, ততদিন খেলাপি বাড়তেই থাকবে।
তিনি বলেন, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি। আবার ব্যালান্স শিটে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে গিয়েই ব্যাংকগুলো নিজেরাই ঢালাওভাবে বড় কিছু গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই বছরে ব্যাংক থেকে ২০ হাজার ৮১ কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যায়। ২০১২ সালের প্রত্যেক মাসে গড়ে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা করে ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেওয়া হয়। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১৩ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই বছরে ব্যাংকের টাকা লোপাট হয় আরও ১৩ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৭ হাজার ২৯০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। ওই এক বছরে ১৪ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। ২০১৭ সালের প্রত্যেক মাসে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে এক হাজার ২১৪ কোটি টাকারও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে নতুন করে ঋণ খেলাপি হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত প্রত্যেক মাসে ব্যাংক থেকে হাওয়া হয়ে গেছে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ। গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে (জুন-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। সর্বশেষ তিন মাসের প্রত্যেক মাসে গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা করে লোপাট হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বাড়লেও ডিসেম্বর প্রান্তিকে এসে কমে যাবে। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি আদায়ে নির্দেশ দেওয়া আছে। কাজেই ব্যাংকগুলো আদায় বাড়ালেই খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০১৩-২০১৭) ব্যাংকগুলো থেকে ৮৪ হাজার ৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা পেয়েছেন খেলাপি গ্রাহকরা।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রভাবশালী গ্রাহকদের চাপের মুখে পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক। এমনকি একই গ্রাহকের কোনও কোনও ঋণ ১০ বারও পুনঃতফসিল করতে হয়েছে। এরপরও এসব গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংকের টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেওয়ার কারণে আরও এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বছরের পরপর আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক খাত সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ হলো সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি অন্যতম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের কারণে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

 

http://www.dailysangram.com/post/356462