৬ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:২৬

জিএসপি স্থগিতের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

শ্রম ও মানবাধিকারে নজর রাখছে ইইউ


শ্রম ও মানবাধিকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে এ দেশে পূর্ণমাত্রার ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানোর কথা বিবেচনা করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এটিই পরে ইইউতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) আংশিক বা পুরোপুরি স্থগিতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মোগেরিনি সমপ্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন।
কূটনীতিক সূত্রগুলো জানায়, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ইউরোপীয় পিপলস পার্টির সদস্য ও ইতালীয় রাজনীতিক বারবারা মাতেরা গত আগস্ট মাসে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইইউ’র পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর ইবিএ চুক্তির বিষয়ে জানতে চান। বারবারা মাতেরা অভিযোগ করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করছে। সরকার অনলাইনে আরো বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোও (আইএনজিও) এসব আইন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে।

বারবারা মাতেরা মানবাধিকারবিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশনের দশম অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, প্রত্যেকের মত প্রকাশের অধিকার আছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া যেকোনো ধরনের মত প্রকাশ এবং তথ্য ও ভাবনা জানানো এর অন্যতম। তিনি বলেন, জেনারেল স্কিম অব প্রেফারেন্সের (জিএসপি) আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ইবিএ স্কিম রয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশ ইইউর বাজারে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া অন্য সব পণ্য রফতানীতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পাচ্ছে। ইইউকে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে তিনি জানতে চান, বাংলাদেশে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে মৌলিক অধিকার হুমকিতে পড়েছে-এটি কি ইউরোপীয় কমিশন স্বীকার করে? আর যদি করেই তবে এসব আইন সংস্কারে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহী করতে কমিশন কী উদ্যোগ নিয়েছে?

বাংলাদেশে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকে ইবিএ চুক্তিরও লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে বারবারা মাতেরা জানতে চান, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কমিশন কিভাবে এগোতে চাচ্ছে?
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি বারবারা মাতেরার সেই প্রশ্নগুলোর লিখিত জবাব দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মোগেরিনি। তিনি জানান, ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশন কাঠামোর আওতায় ইইউ অব্যাহতভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকার ইস্যু তুলে ধরছে। চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল ঢাকায় সুশাসন, মানবাধিকার ও অভিবাসনবিষয়ক ইইউ-বাংলাদেশ সাব-গ্রুপের বৈঠকে ইইউ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এরপর ২৬ এপ্রিল যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে এবং তা ইস্যু করা হয়েছে। গত ১৯ জুলাই ঢাকায় ইইউ-বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনায়ও ইইউ বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়েও উদ্বেগ জানায়।
ফেদেরিকা মোগেরিনি আরো জানান, ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিস ও বাংলাদেশে ইইউ ডেলিগেশন বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের কাঠামোর আওতায় এবং অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ইইউ এসব ইস্যু তুলে ধরা এবং উদ্বেগ জানানো অব্যাহত রাখবে।
ইইউতে বাংলাদেশের জিএসপি প্রসঙ্গে মোগেরিনি বলেন, ২০১৬-১৭ সাল মেয়াদে জিএসপি বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় কাউন্সিলে ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জিএসপিবিষয়ক ইবিএ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউ তার সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। বর্ধিত সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে শ্রম ইস্যুতে গুরুত্ব দিয়ে প্রথম কারিগরি মিশন গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফর করেছে।

ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, ওই মিশন সফর করার পরপরই বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন করেছে। বর্তমানে এটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ওই মিশনের প্রতিবেদন ও সংস্কারবিষয়ক পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে কমিশন তার পরবর্তী করণীয় বিবেচনা করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বর্ধিত সম্পৃক্ততা যদি সন্তোষজনক ফল দিতে ব্যর্থ হয় তবে কমিশন মানবাধিকার ও শ্রম উভয় পরিস্থিতি দেখতে পূর্ণ ইবিএ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে।
ইইউতে জিএসপি বাতিল করার ক্ষেত্রে কমিশন বাংলাদেশের ওপর এর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক প্রভাব বিবেচনা করবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন। ঢাকা ও ব্রাসেলসের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইইউতে বাংলাদেশের জিএসপির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা দুশ্চিন্তায় আছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা মান নজরদারিতে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম মেয়াদ বাড়াতে চাপ দিয়েছিল। গত ১৫ নভেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্ট অ্যাকর্ডের বিষয়টি উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/170390