৬ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:১৭

১০ বছরে খেলাপি ঋণ হয়েছে সাড়ে ৫ গুণ দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকিং খাত

বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৫ শ’ শতাংশ। আর অবলোপন বাদে (নিট) খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩ শ’ শতাংশ। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে। তখন ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আর ঋণ অবলোপন ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে সামগ্রিক খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।

ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। এতে ফি বছরই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঋণের সুদের হারে। কাক্সিক্ষত হারে সুদহার কমাতে পারছে না। আবার ঋণ আটকে পড়ায় ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নতুন ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। ফলে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ছে। কমছে প্রকৃত আয়। এভাবেই দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব এবং ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। সোনালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংকের মতো কিছু ব্যাংক বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে উচ্চ খেলাপি ঋণে জর্জরিত। এ ছাড়া সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংকসহ কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, উপরন্তু জনগণের করের টাকা দিয়ে সরকার ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দিচ্ছে। এতে ব্যাংক লুটপাটকারীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে। তারা বলছে, আর যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে খেলাপি সংস্কৃতি কমবে না। বরং খেলাপি ঋণ বাড়লে ভালো গ্রাহকদের দুর্ভোগই সবচেয়ে বেশি। কারণ যারা খেলাপি হয়েছেন, তাদের নেয়া ঋণের সুদাসল না পেয়ে ব্যাংক ভালো গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার সময় সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, অবলোপনকৃত ঋণ মন্দ ঋণ হওয়ায় নীতিমালা অনুযায়ী এসব ঋণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকিং খাতে এ দৃশ্যমান খেলাপির চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে অদৃশ্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ; যার হিসাব প্রকৃতপক্ষে আনা যাচ্ছে না। এসব ঋণগ্রহীতা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাচ্ছে না।

গত ১০ বছরে মোটা দাগে যেসব ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা জনগণ জেনেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, এনন টেক্স, ক্রেসেন্ট লেদার প্রভৃতি। অখ্যাত কোম্পানি হলমার্ক সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটি সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য উদঘাটনের পর তদন্ত কমিটির কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। বাধা দেয়া হয় হলমার্ক হাতিয়ে নেয়া অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগীদের তথ্য উদঘাটনে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা বিদেশে পাড়ি জমান। বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ টাকা আজো উদ্ধার হয়নি। ফলে একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবে উদাহরণ দেয়া যেত, সেই বেসিক ব্যাংক এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বর্তমান সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের লাইসেন্স নেয়া ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়। সাধারণ গ্রাহকেরা ব্যাংকের টাকা আজো ফেরত পাচ্ছে না। উপরন্তু ব্যাংকটিকে সরকারি ৫টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে স্যালাইন হিসেবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হালে জনতা ব্যাংক থেকে এনন টেক্স ও ক্রিসেন্ট লেদার নামক আরো দু’টি কোম্পানির প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে। এর বাইরে শীর্ষ আরো ৫-৬টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা বের করে নিচ্ছে। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে না পারছে ব্যাংক কিছু করতে, না পারছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক লুটপাট ও খেলাপির ভয়ঙ্কর এ চিত্র এক দশক আগেও চোখে পড়েনি। তখন ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ প্রকৃত অর্থেই লোকসান করে খেলাপি হতেন। খুব কমসংখ্যক ব্যবসায়ীই ঋণ নিয়ে ইচ্ছা করে খেলাপি হতেন। খেলাপি ঋণ ‘মহামারি আকার’ ধারণ করেছে মূলত ২০১২ সাল থেকে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা, আর অবলোপনকৃত ঋণ ছিল ১১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে অবলোপনসহ ওই সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা।

গত ১০ বছরের খেলাপি ঋণের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০০৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকায় নামে, খেলাপির হার দাঁড়ায় ১০.৭৯ শতাংশ। এই ঋণ ও এর হার পরের বছরগুলোতে ছিল এ রকম : ২০০৯ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.২১ শতাংশ। ২০১০ সালে ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং মোট ঋণের ৭.২৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা (৬.১২ শতাংশ), ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা (১০.০৩ শতাংশ), ২০১৩ সালে ৪০ হাজার ৫৮৩ টাকা (৮.৯৩ শতাংশ), ২০১৪ সালে ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা (৯.৬৩ শতাংশ), ২০১৫ সালে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা (৮.৭৯ শতাংশ) এবং ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা (৯.২৩ শতাংশ)। আর ২০১৭ সাল শেষে খেলাপি ঋণ হয় ৭৪ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৭ কোটি টাকার ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর এ সময়ে অবলোপন হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ছে এবং ভালো ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে জালিয়াতি করে ঋণ দেয়া ও নেয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, তাকে ‘ব্যাংক লুটপাট’-এর সাথে তুলনা করছেন বিশ্লেষকেরা। একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও এখন এ সংস্কৃতি বেশির ভাগ ব্যাংকেই ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকাররাও ভুয়া কাগজে ঋণের নামে টাকা দিয়ে বিশাল অঙ্কের কমিশন খাচ্ছেন। সরকারি বিভিন্ন বৈঠকেও ব্যাংক থেকে জাল-জালিয়াতি করে টাকা নিয়ে পরিশোধ না করার ঘটনাকে ‘লুটপাট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনে ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/370166