৬ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:০৫

নির্বাচন কমিশন

মনোনয়ন বাতিলে একই মানদণ্ড ছিল কি?

আলী রীয়াজ

আসন্ন নির্বাচনের একটা বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে। এই যাচাই-বাছাইয়ের ফলে যাঁদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে কমিশনের কাছে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন, তিন দিন সুযোগ পাবেন প্রার্থীরা—প্রথম দিনে ৮৪ জন আপিল করেছেন, অনুমান করা যায় শেষ পর্যন্ত আরও অনেকেই আপিল করবেন। এসব আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থীর তালিকা সম্পূর্ণ হয়েছে তা বলা যাবে না। তারপরে তো আদালত আছেই। ফলে কমিশনের এসব সিদ্ধান্তকেও চূড়ান্ত বলার অবকাশ নেই। এই বাছাইয়ের পরে এটা স্পষ্ট যে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না ঘটলে বিএনপির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের পরে এই প্রথমবারের মতো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছেন না।

গত ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে সংশয় ছিল, কিন্তু অতীতের বিভিন্ন উদাহরণ, ভিন্ন ভিন্ন
রায় এবং সাম্প্রতিক কালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের রায় থেকে এমন ব্যবস্থার সুযোগ ছিল, যাতে খালেদা জিয়া প্রার্থী হওয়ার পরও এর সমাধান হতে পারে। প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা স্মরণ করতে পারি, সাবেক সেনাশাসক এরশাদ নির্বাচিত হওয়ার চার বছর পরে তাঁর সদস্যপদ হারিয়েছিলেন, আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কেবল নির্বাচিতই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার ইতিহাসও আছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংসদ পদ হারান তারপরে (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর ২০১৮)। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে তা হয়নি। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বিষয়টি সম্ভবত আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু তার বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে বাছাইয়ের যে তালিকা দেখা যাচ্ছে, তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাতিলের যে হার তাতে কমিশন রেকর্ড তৈরি করেছে। এই রেকর্ডে সহজে দৃশ্যমান, তার চেয়েও বেশি দৃশ্যমান হয়েছে এই বাতিলের তালিকায় একটি সুস্পষ্ট প্যাটার্ন, বিরোধী দলের যাঁরা প্রধান প্রার্থী, তাঁদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে বেশুমারভাবে। সংবাদপত্রের হিসাবে বিরোধী দলের ১৪১ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের হয়েছে মাত্র ৩ জনের। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রার্থীদের প্রার্থিতা কেবল বহালই থেকেছে তা-ই নয়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের এক বড় সংখ্যকের মনোনয়নপত্র বিভিন্ন কারণে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যে অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে হতো দলকে, তার অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের মাধ্যমেই। এতে করে আওয়ামী লীগ নিঃসন্দেহে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাতে পারে। একইভাবে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হতে আগ্রহীদের তিন-চতুর্থাংশের মনোনয়নপত্র বাতিলের ঘটনা ঘটেছে।

বাতিলের জন্য সর্বত্রই একই মানদণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে কি না, সেই নিয়ে আসল সংশয়। অভিযোগ আছে হলফনামায় জেনারেল এরশাদের দেওয়া স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাবের সঙ্গে অমিল রয়েছে রওশন এরশাদের নিজের দেওয়া হিসাব বিবরণীর (‘একই সম্পদে এরশাদ ও রওশনের ভিন্ন তথ্য’, প্রিয়ডটকম, ২ ডিসেম্বর ২০১৮)। জাতীয় পার্টির এই দুই কর্ণধার সব মিলে চারটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁদের হিসাবের এই গরমিলে কমিশনের কোনো আপত্তির কথা শোনা যায়নি। অথচ নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিলে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার কথা। অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ডের সার্ভিস চার্জকে ঋণখেলাপ বলে বিবেচনা করা হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রেই যেসব কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, সেগুলো চাইলেই এড়ানো যেত যদি জেলা প্রশাসকেরা সবার অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনায় নিতেন। গোলাম মাওলা রনির মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণ হচ্ছে হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকা; চাইলেই কি তাঁকে এ বিষয়ে
অবহিত করা যেত না? মানিকগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী মাইনুল ইসলামের মনোনয়নপত্রে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরের সঙ্গে হুবহু মিল না থাকায় তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুলের কাছ থেকে জেনে নেওয়া কি অসম্ভব ছিল?
অনেক ক্ষেত্রে বিএনপি তাদের নেতাদের মনোনয়ন দিলেও তার বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছিল। তাতে বোঝাই যায় বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানতেন যে তাঁদের অনেক নেতা বিরাজমান আইনের কারণে প্রার্থী হতে পারবেন না, কিন্তু তাঁদের আগে থেকে বাদ দেওয়া দলের জন্য শোভন বা কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্তের এবং কৌশলের রাজনৈতিক মর্ম বোঝা যায়। কিন্তু যখন তাঁদের বিকল্প প্রার্থীদের একই কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে যে এ বিষয়ে যতটা সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার, ততটা তাঁরা করেননি। এটা তাঁদের দুর্বলতার প্রকাশ বললে সামান্যই বলা হবে। এতে করে দু–একটি ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো প্রার্থীই থাকবে না।

উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য পদত্যাগ করতে হবে বলে কমিশনের দেওয়া এক মনগড়া ব্যাখ্যার ফলে এখন এক লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পদত্যাগী চেয়ারম্যানরা এখন না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় পড়েছেন। এই অবস্থার দায় অবশ্যই কমিশনের ঘাড়েই বর্তায়।
অনেকেই বলবেন, ছোটখাটো ত্রুটি সারানোর উপায় তো আছেই—আপিল প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, ফলে আপিলেই এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি করা যাবে। সম্ভবত কিছু কিছু তা ঘটবেও। কিন্তু একদিকে কিছু প্রার্থী আপিলে ব্যস্ত থাকবেন আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রচারণা চালাবেন। এমনিতেই বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী ঘরছাড়া, অনেকেরই জামিনের জন্য আদালতের বারান্দায় সময় কাটছে। তার সঙ্গে এই আপিলের কাজে আরও কিছু প্রার্থীকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে।
কিন্তু এসব বিষয় এড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের আগ্রহ ও আন্তরিকতাই প্রমাণিত হতো। কিন্তু তার পরিবর্তে যেভাবে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের হিড়িক দেখা গেছে, তাতে একটা বিষয় মনে হয়েছে যে কমিশনের কাছে সবাই সমানভাবে বিবেচিত হচ্ছেন না। কোনো কোনো আসনে প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো; যেন এটা প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে বিরোধী দলের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকায় বিরোধী দল এখন অস্তিত্বহীন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকার দাবি যে বাস্তবের সঙ্গে কতটা অসংগতিপূর্ণ, এসব ঘটনাতেই তা দেখা যাচ্ছে এবং এগুলো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। আশা করি কমিশনের সদস্যরা তা অনুধাবন করতে পারছেন। সোমবার সকালে নির্বাচন কমিশন ভবনে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করার সময়ে কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থী যেন নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, সে ব্যবস্থা করবেন। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কাছে চাওয়া খুবই সামান্য—একজন ভোটার যেন নির্ভয়ে পছন্দমতো তাঁর প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন, সেই আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
তিনি বলেছেন, নির্বাচনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেবে না কমিশন। ভোটাররাও তাই চান; তাঁরা চান তাঁরা যেন ভোটকেন্দ্রে নির্ভয়ে যেতে পারেন, নিজের ভোট যেন নিজে দিতে পারেন এবং তাঁদের দেওয়া ভোট যেন যথাযথভাবে গণনা করা হয়। নির্বাচন কমিশনের কাজ এগুলো শত ভাগ নিশ্চিত করা।
আলী রীয়াজ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

 

https://www.prothomalo.com/opinion/article/1568544