৪ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১৯

অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ

গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। অবলোপন বাদেই খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে; কিন্তু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাব পড়ার শঙ্কায় এ প্রতিবেদন এখন অনুমোদন করছে না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু বেশি বেড়েছে এমন কয়েকটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, নানা কারণে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে গেছে। আবার যেটুকু আদায় হচ্ছে তার বড় একটি অংশই কাগজে-কলমে আদায় হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই খেলাপি ঋণের আধিক্য বাড়ছে। যেমন ডিসেম্বর শেষে খেলাপি যেখানে ছিল ৭৪ হাজার কোটি টাকা; গত মার্চ শেষে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা, জুন শেষে তা আরো বেড়ে হয় ৮৯ হাজার কোটি টাকা।

একটি অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর শেষে তা ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে বেড়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে; কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে খেলাপি ঋণের এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রভাব ফেলতে পারে এ শঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশে অনেকটা কালক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, প্রতি তিন মাস অন্তর খেলাপি ঋণের চিত্র হালনাগাদ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাধারণত বছরে চার প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের এ চিত্র হালনাগাদ করা হয়। এ চার প্রান্তিক হলো মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর। ব্যাংকগুলো তিন মাসের খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান পরের মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠায়। ব্যাংকগুলোর পাঠানো তথ্য প্রতিবেদন আকারে তিন মাসের পরবর্তী মাসের শেষ দিকে তা চূড়ান্ত করে। এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনকে সামনে রেখে ব্যাংক থেকে সরবরাহ করা তথ্য যাচাই-বাছাই করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে পাহাড় সমান খেলাপি ঋণের চিত্র দেখে ভড়কে যান তারা। ফলে নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণের এ প্রতিবেদন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এ শঙ্কায় খেলাপি ঋণের এ প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়নি। একটি অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে এমন কয়েকটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের তথ্য সংশোধন করার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদন আগামী সপ্তাহে অনুমোদন হতে পারে। তিনি জানান, অনেক সময় ব্যাংকগুলো ভুল তথ্য দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তা সংশোধন করতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রায়ই খেলাপি ঋণের চিত্র গোপন করার অভিযোগ ওঠে। যেমন ২০১৪ ও ২০১৫ সালের শেষদিকে যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি ওই সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, যেকোনো উপায়ে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। বছর শেষ হওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে এ নির্দেশনা পাওয়ার পর ব্যাংকগুলো কোমর বেঁধে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনে। ওই সময় ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারে পরিচালনা পর্ষদ ডেকে সরকারি ব্যাংকগুলো শত শত ঋণখেলাপির ঋণ ডাউন পেমেন্ট না নিয়েই নবায়ন করে। একই সাথে ২০১৪ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে ও সুদহার ছাড় দিয়ে ১৪টি বড় শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আড়াল করা হয়; কিন্তু পরে ওই ঋণের কিস্তি ব্যবসায়ীরা পরিশোধ না করায় তা একপর্যায়ে আবার খেলাপি ঋণে পরিণত হয়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে এক দিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে; কিন্তু এর বিপরীতে কমে যাচ্ছে আদায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তিন মাসে (জুন শেষে) অবলোপনসহ প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার মাত্র ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে আয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিরা ঋণ আদায় না করায় ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন, নিয়মিত যারা ঋণ পরিশোধ করছেন তারা। কারণ ব্যাংক থেকে একজন ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে ব্যবসা করায় তার ব্যবসায়ী ব্যয় কমে যায়। অপর দিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুদে-আসলে পরিশোধ করায় তুলনামূলকভাবে অপর ব্যবসায়ীর ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়। এ অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা পেতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন ওই সব গ্রাহক ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। এভাবেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। এর বাইরে বড় শিল্প গ্রুপগুলো যে পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে তার বেশির ভাগই পরিশোধ করছে না। উপরন্তু কিছু কিছু ঋণ কাগজে আদায় দেখানো হচ্ছে। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে খেলাপি ঋণের ওপর।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/369659