৪ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১৮

সাজানো প্রশাসন ॥ একতরফা নির্বাচনের ছক

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আবারো একতরফা নির্বাচনের ছক তৈরি করছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যেভাবে তফসিল ঘোষণার পরও বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, গুম, হত্যা করা হচ্ছে তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিন্দুমাত্র লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া যেভাবে বিএনপি ও স্বতন্ত্র মনোনয়ন প্রার্থীদের আবেদন বাতিল করা হলো এবং স্বাক্ষর না থাকা সত্ত্বেও সরকারি দলের মনোনয়নের বৈধতা দেয়া হলো, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২৩ দলীয় জোট একদিকে যেমন আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে তেমনি নির্বাচন বয়কট করারও ঘোষণা দিয়েছে।

রোববার ২৩ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে জোটের মুখপাত্র কর্ণেল অলি আহমদ বলেছেন, বাছাইতে জোটের ৮০ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করে সরকারি দলের জয়লাভকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। সারাদেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের এমনকি প্রার্থীদেরও গ্রেফতার হচ্ছে। এভাবে হলে বিরোধী দলে আমরা যারা আছি আমাদের পক্ষে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে টিকে থাকা হয়ত সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে বললে অলি বলেন, দেখুন আমরা তো নির্বাচন করতে চাই, নির্বাচনে আছি। এখন প্রার্থী যদি না থাকে তাহলে কাকে নিয়ে নির্বাচন করবেন? ইতিমধ্যে তো ৮০ জন নেই। সরকার তো কাউকে ঘরে থাকতে দিচ্ছে না। প্রতিদিন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ মোটেও নাই, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নাই। এভাবে ভয়ভীতি ও গ্রেফতার হলে আপনারাই বলুন আমরা কীভাবে নির্বাচন করব। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা চাই।

এর আগে গত রোববার বিএনপি মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্যন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া আমাদের অন্যকোন পথ খোলা থাকবে না। এছাড়া তিনি নির্বাচনে বিরোধী জোট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা সেটি নিয়ে কথা বলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, এই নির্বাচনে আমরা অংশ নিচ্ছি গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য, নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্ত করার জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পরেও এখনো বেআইনিভাবে গায়েবি মামলায় শত শত নেতাকর্মী আটক করা হচ্ছে। প্রতিদিন করা হচ্ছে। প্রার্থী যারা হচ্ছেন, যারা আগে এমপি ছিলেন তাদেরকেও করা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচনের যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সেটা কোনোমতে তৈরি হবে না।

নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে তার জন্য পরিবেশ দরকার। সেখানে সকলে যাতে মুক্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য, ভোট দেয়ার জন্য ভূমিকা রাখতে পারে- সেজন্য অপরিহার্য হচ্ছে সুষ্ঠু পরিবেশ। সেটা আমরা বার বার ভুলে যাচ্ছি। সুষ্ঠু পরিবেশের পরিপন্থি হচ্ছে পাইকারী হারে গ্রেফতার। যেটা চলছে এটা সুষ্ঠু পরিবেশ নয়। তফসিল ঘোষণার পরে সাত শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন প্রার্থীও আছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন। আমার কথা হলো স্বাভাবিক পরিবেশ রাখার জন্য এই গ্রেফতার বন্ধ করা হোক। যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে বিশেষ করে যারা প্রার্থী তাদের সকলকে মুক্ত করা হোক।
সূত্র মতে, একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় রয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন, জেনুইন নির্বাচন না হলে বিপর্যয় নামবে। বলা যায়- সারাবিশ্বই বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছে। বাংলাদেশে সহিংসতামুক্ত, নিরপেক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটা নির্বাচন দেখতে চায় গোটা দুনিয়া। রেফারি হিসেবে নির্বাচন কমিশন হবে পুরোপুরি নিরপেক্ষ, কমিশনের ভেতরে থেকে কেউ সিস্টেমেটিক ম্যানুপুলেশন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারবে না- এমনটিই আশা করে সবাই।

কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশির নামে হয়রানি করা হচ্ছে। গায়েবি মামলায় এখনো গ্রেফতার-নির্যাতন চলছে। সাধারণ ভোটাররা আতংকিত- আদৌ সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত পরিবেশে ভোট দিতে পারবেন কিনা। কারণ, ইতিমধ্যেই অভিযোগ এসেছে যে, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী জেলা রিটার্নিং অফিসার বা ডিসিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গোপন বৈঠক করা হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারাসহ সিভিল প্রশাসন ও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তারা গোপন বৈঠক করেছেন এবং নির্বাচনে কারচুপির ছক তৈরি করছেন মর্মেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিরোধীদলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের প্রতি বার বার লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির দাবি তোলা হলেও ইসি তাতে কর্তপাত করছে না। সিইসি সচিবের সহযোগিতায় ভোট কারচুপির ছক তৈরি করা হচ্ছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

গত ২২ নবেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে সিভিল প্রশাসন ও পুলিশের ৯২ জন কর্মকর্তার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, র্যা বের ডিজি, ঢাকার পুলিশ কমিশনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তারা। বলা হয়েছে এরা একেবারেই সরকারদলীয় কর্মকর্তা। ভোট কারচুপির পরিকল্পনার সঙ্গে এরা জড়িত। এদের সরিয়ে সিনিয়রিটি অনুযায়ী নিরপেক্ষ কর্মকর্তা পদায়ন করা না হলে লেভেল প্লেইং ফিল্ড হবে না। এদিকে একই দিনে পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠকে ইসি মাহবুব তালুকদার বলেছেন, গায়েবি মামলার সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই একই দিনে দলবাজ পুলিশ অফিসারদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, কাউকেই বদলি করা হবে না। অর্থাৎ এদের সবাইকে ষড়যন্ত্র ও অপকর্ম করার লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছেন তিনি। এমনকি প্রশাসনে অভিযুক্তদের বদলি বা কোনোরকমের ব্যবস্থা না নিয়েই সিইসি কেএম নুরুল হুদা গত ২৪ নবেম্বর এক বক্তৃতায় বলেছেন, লেভেল প্লেইং ফিল্ড হয়ে গেছে। ওইদিন তিনি ম্যাজিস্ট্রেটদের বলেছেন, প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া কেন্দ্রে ঢোকা যাবে না। এর আগে ইসি সচিব বলেছেন, পর্যবেক্ষকদের মুর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সিইসি কেএম নুরুল হুদার একের পর এক চরম একপেশে ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন অবশেষে বাধ্য হয়ে তার অপসারণ চেয়েছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে বসে নির্বাচনের ছক সাজানো হচ্ছে। রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, সাজানো প্রশাসনে পাতানো নির্বাচনের ছক তৈরি করা হয়েছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না।

সূত্র মতে, ২৩ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে যে ৯২ জন কর্মকর্তাকে বদলির দাবি তোলা হয়েছে তারমধ্যে ইসি সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবসহ সিভিল প্রশাসনের রয়েছেন ২২ জন। বাকিরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন ও মাঠ পর্যায়ের বহুল আলোচিত কর্মকর্তা। ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, শতাধিক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তাকে সচিব করেছে বর্তমান সরকার। তিনি সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের পিএস ছিলেন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন অফিসে বসে আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ভোট কারচুপির যড়যন্ত্র করছেন। শুধু ইসি সচিব হেলাল উদ্দীনই নয়, এখন যারা পুলিশ এবং সিভিল উভয় প্রশাসনের উচ্চপদে আছেন সকলের অতীত-বর্তমান পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করেই এদেরকে এই পর্যায় পর্যন্ত আনা হয়েছে, যাতে নির্বাচনের সময় দলীয় কাজে লাগানো যায়। দফায় দফায় পদোন্নতিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে এদেরকে। এক কথায় বলা যায়, ডিএনএ টেস্টে উত্তীর্ণ কর্মকর্তা এরা। ইসি মাহবুব তালুকদার গায়েবী মামলাসহ দু’একটি উদাহরণ দিয়ে এসব কর্মকর্তার আচরণ কিছুটা তুলে ধরেছেন যদিও, কিন্তু বাস্তব অবস্থা তারচেয়েও খারাপ। ইতিমধ্যেই ভোট কারচুপির ছক তৈরির অভিযোগ উঠেছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু এরা আওয়ামী লীগ থেকে মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা নিয়েছেন, কাজেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার সকল কলাকৌশল তারা চালাবেন এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখাটা তাদের জন্য জরুরি। মরিয়া হয়ে কাজ করবেন। তাই করছেন। একেবারে উপসচিব থেকেই ছেঁকে অর্থাৎ যাচাই-বাছাই করে দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি দিয়ে এসব কর্মকর্তাকে উপরে তোলা হয়েছে। দেখা গেছে, পদোন্নতির প্রত্যেকটি ধাপেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে পুনঃ পুনঃযাচাই-বাছাই করা হয়েছে। কোনো রকমের সন্দেহজনক মনে হলেই তাকে পদোন্নতি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। নিজে ছাড়াও আত্মীয়স্বজন কেউ বিরোধীদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হয়েছে। ছাত্রজীবন এবং চাকরীজীবনে যারা কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, নিরপেক্ষ বলে বরাবর পরিচিত ছিলেন তাদেরকেও বিরোধী পক্ষের বলে চিহ্নিত করে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ডিসি-এসপিসহ মাঠ প্রশাসন, সচিবালয় এবং পুলিশের উচ্চ পর্যায়সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে তো ডিএনএ টেস্টের মতো করে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে বার বার। মাঠ প্রশাসনের জন্য ফিট লিস্টের পরও, এমনকি স্ত্রী-পরিবারসহ ট্রেনিং নেয়ার পরও অনেককে পদায়ন করা হয়নি। দলকানা সিভিল প্রশাসন ও পুলিশের বাছাই করা লোকদের নিয়ে গত ছয় মাসে মাঠ প্রশাসন সাজানো হয়। উভয় প্রশাসনকেই তিন স্তরে সাজানো হয়েছে। সরকারি দল ধরেই নিয়েছিল নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে এসব দলবাজ কর্মকর্তার বিষয়ে আপত্তি উঠবে। আর যদি সে ক্ষেত্রে প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন আনতেই হয় সেজন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের কর্মকর্তাদেরও তৈরি রাখা হয়েছে। যাতে করে পরিবর্তনেও কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে। একজন সাবেক প্রবীণ আমলার নেতৃত্বেই প্রশাসনের এ সেটআপ তৈরি করা হয়। সামান্য সন্দেহযুক্ত কাউকেই নির্বাচনকালীন এ মাঠ প্রশাসনে সংশ্লিষ্ট রাখা হয়নি। পুলিশ প্রশাসনের সব কর্মকর্তার নির্বাচনের সময়ে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হয়নি। যেসব কর্মকর্তা বর্তমান সরকারের সময়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে একাধিক মামলার বাদি ছিলেন বেছে বেছে তাদেরকেই দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়।

রির্টানিং অফিসার অর্থাৎ ডিসিদের ডেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে গোপন বৈঠকের অভিযোগ উঠছে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত ২৪ নবেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে এই মর্মে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, গত ২০ নবেম্বর মঙ্গলবার রাতে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের চার তলার পিছনের কনফারেন্স রুমে এক গোপন মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদুল হাসান, জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ, নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, সচিব পানিসম্পদ (প্রধানমন্ত্রীর অফিসের প্রাক্তন ডিজি) কবির বিন আনোয়ার, বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব মহিবুল হক, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার (মহানগরীর রিটার্নিং অফিসার) ও সদস্য সচিব আলী আজম, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ (জজ কাজী গোলাম রসুলের মেয়ে) কাজী নিশাত রসুল, র্যা বের ডিজি বেনজীর আহমেদ, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপির কাউন্টার টেররিজমের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম, পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের ডিআইজি প্রশাসন হাবিবুর রহমান, ডিএমপির ডিসি প্রলয় জোয়ার্দার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাক্তন প্রটোকল অফিসার) প্রমুখ। রুহুল কবীর রিজভী জানান, ওইদিন রাত সাড়ে ৭টা থেকে আড়াই ঘন্টা ধরে চলা এ মিটিংয়ে সারাদেশের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সেট-আপ ও প্ল্যান রিভিউ করা হয়। ডিআইজি হাবিব ওই মিটিংয়ে জানায়, পুলিশ সূত্রের খবর অনুযায়ী ৩৩টি সিট নৌকার কনফার্ম আছে এবং ৬০-৬৫ টিতে কনটেস্ট হবে, বাকি আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই সাংঘাতিক কিছু করা ছাড়া এ খেলা উৎরানো যাবে না।
তিনি জানান, ওই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা শেষে মূল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নির্বাচন কমিশন থেকে বিএনপি-ফ্রন্টকে চরম অসহযোগিতা করা হবে, যতই চাপ দেয়া হোক প্রশাসনে হাত দেয়া যাবেনা, ধরপাকড় বাড়ানো হবে, প্রার্থী গুম খুণ করে এমন অবস্থা তৈরি করা হবে যাতে তারা নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর শেষ পর্যন্ত ভোটে থেকে গেলে ভোটের দিন পর্যন্ত ধরপাকড়ের তান্ডব চালানো হবে নির্দয়ভাবে, যেনো ভোট কেন্দ্রে কেউ হাজির হতে সাহস না করে। আর যদি ভোটের ফ্লো ঠেকানো না যায়, তবে মিডিয়া ক্যু করে নৌকাকে জিতানো হবে, বিটিভির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করে সব মিডিয়াতে তা রিলে করার ব্যবস্থা করা হবে। একবার ফল ঘোষণা করতে পারলে তারপরে নির্মমভাবে সব ঠান্ডা করা হবে। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প তদারকির নামে আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ৮ জন আওয়ামী দলীয় কর্মকর্তা দিয়ে মনিটরিং সেল গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান ৪৫ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ৬৪ জেলার উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগ করে একটি নজিরবিহীন সরকারি আদেশ জারি করেছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

জানা গেছে, একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। তারা বাংলাদেশে অবাধ. সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় বলে জানিয়েছে। তবে তাঁদের উদ্বেগ এবং হুঁশিয়ারিকে পরোয়া করে না বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাদের উদ্বেগ-হুঁশিয়ারিকে আওয়ামী লীগ পরোয়া করে না। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা বন্ধ করে দিক। তাতে কিছু যায়-আসে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নানামহল থেকে সমালোচনা হলেও নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ইসি সচিব বলেছেন, প্রতীক বরাদ্দের আগে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই এর দু’দিন পর সিইসি নুরুল হুদা ঘোষণা করলেন, লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি হয়ে গেছে। এতে মনে হচ্ছে যে, তিনি আদতে বিরোধীদলের দাবির সঙ্গে কৌতুক করলেন। পুলিশ প্রশাসনের বর্তমান কর্মকান্ড নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আশংকা প্রকাশ করার একদিন পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা বললেন, লেভেল প্লেইং ফিল্ড হয়ে গেছে। লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই সিইসি এমন বক্তব্য দিলেন। তিনি আসলে কী চান তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দলবাজ বা দলীয় আনুগত্যের সব সীমারেখা তিনি ইতিমধ্যে অতিক্রম করেছেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
খান মোঃ নুরুল হুদা, সংক্ষেপে কেএম হুদা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, একথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। চাকরি জীবনেও তার সেই ধারা অব্যাহত ছিল। ১৯৯৬ সালের জনতার মঞ্চের সময় কুমিল্লার ডিসি ছিলেন। সে অবস্থায় তিনি কুমিল্লা থেকে জনতার মঞ্চের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন, কুমিল্লা কালেকটরেট থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি নামিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও নুরুল হুদা এখন সেইসব কথা অস্বীকার করছেন, কিন্তু তার কর্মকান্ডের কথা তখন প্রকাশ হয়েছিল দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সংখ্যায়সহ অন্যান্য জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায়। এ ছাড়াও ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের ঠিক আগে কুমিল্লার ডিসি নুরুল হুদাকে পদ থেকে প্রত্যাহার চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করেছিল বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ১৬৩৫ নম্বর রিটে নূরুল হুদার জনতার মঞ্চ সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ আছে। কাজেই সিইসি নিয়োগ পাওয়ার পরে নুরুল হুদা যেভাবে বলেছেন “জনতার মঞ্চের সাথে জড়িত ছিলাম না, কেননা আমি তখন কুমিল্লায়”- এটা সত্য ভাষণ নয়। নুরুল হুদার গুরুতর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ বিবেচনা করে তাকে আর সরকারি চাকরিতে রাখা সম্ভব নয় বিবেচনায় ২০০১ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। তিনি প্রতিকারের জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে যান, তবে সেখান থেকে কোনো রায় পাওয়ার খবর জানা যায়নি। অথচ বলা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে চাকরি ফেরত পান, এমনকি পেছনের তারিখে পদোন্নতিও নাকি হাইকোর্ট দিয়েছে। আসলে এসব তথ্য সত্য নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেএম নুরুল হুদা অবসরের ১৭ বছরে পরে আওয়ামী লীগ সরকারের দয়ায় একটি সাংবিধানিক পদে চাকরি পেয়েছেন। কাজেই আওয়ামী লীগের প্রতি তার বিশেষ আনুকূল্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে তিনি নিজের ভাগিনাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যদিও এই ভাগিনা আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য কেউ নয়। কিন্তু, সিইসি কেএম নুরুল হুদার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার খেসারত দিতে হবে কি গোটা এই দেশটিকে- সেই প্রশ্ন এখন সামনে এসে গেছে।

জাতীয় ঐক্যজোট, বামজোটসহ সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো আবেদনকে আমলে না নিয়েই নির্বাচন কমিশন অনেকটা একতরফাভাবে তফসিল ঘোষণা করেছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের কথামত এবং তাদের স্বার্থেই যেন নির্বাচন কমিশন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা একের পর এক দলীয় নগ্ন আচরণ করছেন। সব দল একসঙ্গে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করলেও বাতাসে কিন্তু ভিন্ন আওয়াজ বইছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও অনেকে ভেতরে ভেতরে আশংকা প্রকাশ করে বলছেন, নির্বাচন আদৌ হবে না। নির্বাচন না হলে কী হবে অথবা কীভাবে এ সংকটের সমাধান হবে সেকথাও কেউ নিদিষ্ট করে বলতে পারছেন না। আওয়ামী লীগ ইতিপূর্বে অনেকবার বলেছে, বিএনপির হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ বিএনপিকে কোনোক্রমেই নির্বাচিত হতে দেবে না আওয়ামী লীগ।

http://www.dailysangram.com/post/355841