৪ ডিসেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১৩

প্রাসঙ্গিক ভাবনা ॥ ড. মোঃ নূরুল আমিন

বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার নির্যাতনে নির্বাচন বিঘ্নিত হতে পারে

গত শনিবার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি খবর অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। খবর দু’টির মধ্যে একটি হচ্ছে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্য জামায়াত শিবির এবং হেফাজতের নাম উল্লেখ করে জনৈক মার্কিন সিনেটার কর্তৃক ঐ দেশের কংগ্রেসে প্রস্তাব পেশ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করে হিন্দু মহাজোট কর্তৃক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত তথ্য।

প্রথমোক্ত সংবাদে অভিযোগ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং হেফাজতে ইসলাম স্থিতিশীলতা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ। জিম ব্যাঙ্কস নামক জনৈক কংগ্রেস ম্যান তার প্রস্তাবে এই সংগঠনগুলোর তৎপরতা বন্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানোর পাশা-পাশি ইউ এস এ আইডি কর্তৃক তাদের অর্থ সাহায্য প্রদান বন্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছেন। “বাংলাদেশে ধর্মের নামে পরিচালিত গোষ্ঠিগুলোর কারণে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সৃষ্ট হুমকির কারণে উদ্বেগ প্রকাশ “শীর্ষক একটি প্রস্তাবে ইন্ডিয়ানা অঙ্গ রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি জিম ব্যাঙ্কস উপরোক্ত প্রস্তাব করেন। মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি সভার নিম্নকক্ষ প্রস্তাবটি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে প্রেরণ করেছে বলে জানা গেছে।

এই প্রস্তাবের চারটি দফার প্রথমটিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের প্রতি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ও হেফাজতে ইসলামের মতো কট্টর গোষ্ঠিগুলোর হুমকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই সব গোষ্ঠিগুলোকে থামানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তৃতীয় দফায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধকে গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। চতুর্থ দফায় জামায়াত শিবির ও হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন এবং তাদের সঙ্গে অংশিদারিত্ব বন্ধ করার আহ্বান জানান হয়েছে।

দ্বিতীয় সংবাদটি হচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন সংক্রান্ত। এতে বলা হয়েছে যে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সরকার দলীয় নেতাকর্মীসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মী সমর্থকদের দ্বারা হামলা, লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ ১৭৯২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। অনেক ঘটনার সাথে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের অভিযোগও রয়েছে। গত শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের উদ্যোগে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এই অভিযোগ করেছেন। তার অভিযোগ অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের এসব সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী ঘটনার ২৭৩৪.৮১ একর জমি জবর দখল হয়েছে, হত্যার শিকার হয়েছেন ৮১ জন, ২৮৭ জনকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে, হত্যার চেষ্টা হয়েছে ৬৮ জনের উপর, জখম ও আহত করা হয়েছে ৩৪৭ জনকে নিখোঁজ হয়েছে ৪৮ জন, চাঁদাবাজি, মারধর এবং আটক রেখে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১১টি, ঘরবাড়ি ও মন্দির লুটের ঘটনা ঘটেছে ৯২টি। সংগঠনটি এর বিরুদ্ধে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানব বন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে।

খবর দু’টি চমকপ্রদ। দেশের হিন্দু সম্প্রদায় অভিযোগ করছেন যে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে আর সাত সমুদ্র তের নদীর দূরত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক ও কংগ্রেস ম্যানের আবিস্কারে ধরা পড়ছে যে জামায়াত শিবির ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পথে বাধার সৃষ্টি করছে। তার রিপোর্টের বর্ণনা ও শব্দচয়ন থেকে এটা পরিষ্কার যে তিনি কারো শেখানো বুলি আওড়াচ্ছেন। জামায়াত এর প্রতিবাদ করেছে। এটা মার্কিন কংগ্রেসের কোনও সিদ্ধান্ত নয় সম্ভবত: ব্যক্তি বা গোষ্ঠি বিশেষ কর্তৃক প্রভাবিত বা প্রলুব্ধ হয়ে জনৈক কংগ্রেস সদস্যের মিথ্যাচার। বাংলাদেশের প্রকৃত বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই। মানুষের স্বাভাবিক অনুমান হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের কেউ হয়ত তাকে দিয়ে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত শিবির ও ইসলামপন্থীদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টার অংশ হিসেবে এটা করে থাকবেন। এ ধরনের প্রচেষ্টা এর আগেও হয়েছে কিন্তু সফল হয়নি। এই মাত্র খবর পেলাম যে এবারের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে প্রেরিত এই প্রস্তাবটি ৫৩৩ ভোটে পরাজিত হয়েছে, এর পক্ষে ভোট পড়েছে মাত্র একটি এবং বিপক্ষে ৫৩৩টি। ফলে এই ভুয়া প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই আমাদের ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে সবকিছু হারিয়ে ফেলছেন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শত্রু গণ্য করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব রকমের মিথ্যাচার, প্রতারণা ও জুলুম নির্যাতনের আশ্রয় নিচ্ছেন। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন নিয়েও তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর যদিও বলা হচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশনের উপর প্রশাসন পরিচালনার ভার অর্পিত হয়েছে কিন্তু কার্যত: এর কোনও লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন হচ্ছে, এমপি-মন্ত্রীদের ইশারায় প্রশাসন চলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ পর্যন্ত কোনও রাজবন্দির মুক্তি হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম প্রধান বিরোধী দল ও জোটের নেতাকে বন্দি রেখে নির্বাচন হচ্ছে। তার এবং তার দল ও জোটের বন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির কোনও আন্দোলন হয়নি। ইতিহাসের এটি একটি বড় নজির, বিরোধী দল কর্তৃক রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রদর্শনেরও। আওয়ামী লীগ তার বিরোধী দল নিধনে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফল। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে বন্দি করে প্রহসনের বিচারে শাস্তি দিয়ে এবং তার বিকল্প নেতাকে হুমকির মুখে প্রবাসে থাকতে বাধ্য করে এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে এবং তার নিবন্ধন বাতিল করে দলটি এখনও সুস্থির আছে এবং প্রচ- প্রতাপ নিয়ে নির্বাচনী মাঠে এককভাবে লাঠি ঘুরাচ্ছে। সারা দেশে নির্বাচনী বাতাস বইতে শুরু করেছে, মনোনয়নপত্র বাছাই পর্ব শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনো প্রতিদিন প্রায় প্রতিটি জেলায় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের এমনকি নির্বাচন প্রার্থী, তাদের সম্ভাব্য নির্বাচনী ও পোলিং এজেন্ট এবং কর্মীদেরও বাছাই করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার ও মামলার জন্য নাশকতার ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি এখন মাদক চোরাচালানের মিথ্যা মামলা দিয়েও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও এর কোন প্রতিকার হচ্ছে না। মফস্বল শহর ও পল্লী এলাকার পরিস্থিতিকে সংঘাতময় করে তোলার জন্য সরকারের একটি মহল আপ্রাণ চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা একদিকে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর দোকানপাট এবং জমিজমা জবরদখল এবং ভোটের সময় তাদের উপর চাপ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যেমনটি হিন্দু মহাজোট থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী প্রার্থীদের বিকলাঙ্গ করার জন্য তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দিচ্ছে। জেলা উপজেলায় সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং প্রতিদিন পুলিশ দলীয়বাহিনীর সহযোগিতায় পাড়ায় পাড়ায় বাড়ি ঘরে অভিযান চালিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের গ্রেফতারের ফলে দেশে এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও বার্ষিক পরীক্ষা বিঘিœত হচ্ছে। পুলিশ মহিলা এবং ছাত্রীদেরও তাদের নির্যাতন থেকে রেহাই দিচ্ছে না। পুরুষদের গ্রেফতার করতে গিয়ে তাদের না পেয়ে তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও গ্রেফতার করছে। এই অবস্থা অত্যন্ত মর্মান্তিক।
দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় এবং এ পরিবর্তন অহিংস এবং নিয়মতান্ত্রিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। নির্বাচন এর উৎকৃষ্ট পন্থা। নির্বাচনে গায়ের জোর খাটালে সহিংসতার সৃষ্টি হতে পারে যা কারুর জন্যই কাম্য হতে পারে না।

http://www.dailysangram.com/post/355837