৩ ডিসেম্বর ২০১৮, সোমবার, ১০:৫৮

রাঘব বোয়ালরা বেরিয়ে গেল : চুনোপুঁটিরা ধরা

জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাংকিং খাতে পুরনো ঋণ আদায়ের বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর এ কারণে ব্যাংকাররা সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকেন। আদায় হয় বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। এবার অনেকটা হতাশ হয়েছেন ব্যাংকাররা। ব্যাংকারদের জাল থেকে প্রায় অর্ধশত রাঘব বোয়াল ঋণখেলাপি বেরিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য, চিপহুইপ ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী রয়েছেন। আর ধরা খেয়েছেন চুনোপুঁটি ঋণখেলাপিরা। রাঘব বোয়ালদের কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে ঋণখেলাপির ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে নির্বাচনে মনোনয়নপত্রের বাছাই পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কেউ কেউ নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়ন করে ঋণখেলাপির দুর্নাম ঘুচিয়েছেন। কাক্সিক্ষত ঋণ আদায় না হওয়ায় তাই হতাশ হয়েছেন ব্যাংকাররা। বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা গতকাল নয়া দিগন্তকে এ তথ্য দিয়েছেন।

গতকাল বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন এমন প্রার্থীদের মধ্যে ৪১ জন ঋণখেলাপি ছিলেন সোনালী ব্যাংকের। এর মধ্যে ৩২ জন ঋণখেলাপির মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে। বাকি ৯ জন ছিলেন রাঘব বোয়াল ঋণখেলাপি। তারা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে খেলাপির দুর্নাম থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত হয়েছেন। মনোনয়নপত্র দাখিলকারীদের মধ্যে ১৯ জন ঋণখেলাপি ছিলেন জনতা ব্যাংকের। এর মধ্যে ছয়জন ছিলেন প্রভাবশালী ঋণখেলাপি। গতকাল ১৯ জনের মধ্যে ১৩ জন ঋণখেলাপির মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের ৩০ জন ঋণখেলাপির মধ্যে ১৫ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের ১২ জন ঋণখেলাপি ছিলেন। এর মধ্যে তিনজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এর বাইরে বেসিক ব্যাংকের ছয়জন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তিনজন এবং অন্য ব্যাংকগুলোর বাকি প্রায় ২৭ জন ঋণখেলাপির মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। সব মিলে শতাধিক ঋণখেলাপির মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এর বাইরে অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ঋণখেলাপি নানা উপায়ে বেরিয়ে গেছেন।
জানা গেছে, গত দশম জাতীয় নির্বাচন ছিল অনেকটা একতরফা। একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হওয়ায় ওই সময় দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। এর ফলে ১৫৩টি আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ভোট ছাড়াই। এ একতরফা নির্বাচনের আগে কোনো ঋণখেলাপি ব্যাংকের সাথে তেমন যোগাযোগ করেননি।
ব্যাংকাররা জানান, গত ২০০১ ও ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনে যে পরিমাণ ঋণখেলাপি তাদের ঋণ নবায়ন করেছিলেন ২০১৩ এর জাতীয় নির্বাচনে তার শতকরা ২ শতাংশও ঋণ নবায়ন করেননি। এ কারণে তারা (ব্যাংকাররা) তখন হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় অঙ্কের ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আগে থেকেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা সংগ্রহ করে তাদের আমলনামা হাতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু রাঘব বোয়াল ঋণখেলাপিরা নানা কৌশলে বেরিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, সংসদ সদস্য মিলে অর্ধশতাধিক রাঘব বোয়াল ঋণখেলাপি রয়েছেন যারা কোনো রকম অর্থ পরিশোধ ছাড়াই বিভিন্ন উপায়ে ঋণখেলাপি মুক্ত থেকেছেন। ফলে যে রকম প্রত্যাশা করা হয়েছিল ওই পরিমাণ ঋণ আদায় হয়নি এবার নির্বাচনকেন্দ্রিক ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে।

গতকাল অগ্রণী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তারা পুরোপুরি নিরাশ হয়েছিলেন। ওই সময় বড় কোনো নেতা বা বড় অঙ্কের কোনো ঋণখেলাপির ঋণ নবায়ন হয়নি। কেউ ব্যাংকে পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। অথচ এর আগের বছরগুলোতে খেলাপি ঋণের বড় একটা অংশ নির্বাচন কেন্দ্রিক আদায় হতো। গত নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারো বড় ঋণখেলাপিরা তাদের জাল থেকে বেরিয়ে গেছেন নানা প্রভাব খাটিয়ে।
জনতা ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত ২০০১ সালের নির্বাচনে ৩৩৯ জন ঋণখেলাপি নির্বাচন উপলক্ষে তাদের খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিলেন। ২০০৮-এর সংসদ নির্বাচনেও একটি উল্লেখযোগ্য ঋণখেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিল। কিন্তু গত ২০১৩-তে হাতেগোনা ১০ জন ঋণখেলাপি তাদের ঋণ নবায়ন করেছিলেন। এবার নির্বাচনকে ঘিরে ছোট বড় অনেকেই বড় অঙ্কের ঋণ নবায়ন করছেন। কিন্তু রাঘব বোয়ালরা গতবারের মতো এবারো পার পেয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঋণখেলাপিদের ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিলেও আগেই ঋণখেলাপিদের ছাড় দিয়ে নিয়মিত করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রভাবশালী প্রার্থী নানাভাবে সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তাদের খেলাপি ঋণ নবায়ন করে নিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নভেম্বরের শুরু থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যাংকগুলোতে পুনঃতফসিলের হিড়িক পড়ে। ৮ থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ২০৫টি আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আসে। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র দাখিলের পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বরের পর আরো ১৫ জন পুনঃতফসিলের আবেদন করেন। এই আবেদনগুলো বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয় বলে ওই সূত্র জানায়।
প্রসঙ্গত, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি কোনো ধরনের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ছিল ২৮ নভেম্বর। তাই সর্বশেষ ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবের হালনাগাদ করার পরও যারা খেলাপি ছিলেন, তাদের তালিকা সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিসগুলোয় পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের সিআইবি সনদ (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর প্রত্যয়নপত্র) দেয়া হয়। ইসি এ তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু ২৭ নভেম্বরের এ ডেডলাইনের পরের দুই দিন, অর্থাৎ ২৮ ও ২৯ নভেম্বরও নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত হয়েছেন। এ তালিকায় কিছু এমপি ও রাজনৈতিক দলের নেতাও ছিলেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/369352