২৬ নভেম্বর ২০১৮, সোমবার, ১০:৩৩

নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : গ্রাম থেকে শহর কোথাও থেমে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হুমকি-ধামকি। সেই সাথে রয়েছে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান। যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। ভোটাররা চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এই বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে, ভোট কেন্দ্রে গেলেই পরিণতি হবে ভয়াবহ। গত শুক্র ও শনিবার ফেনী ও কুমিল্লার লাঙ্গলকোর্টে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বললে তারা এমন পরিস্থিতির কথা জানান।
শুক্রবার ফেনী-২ ও ৩ আসনের বেশ কয়েকটি এলাকায় এই প্রতিবেদকের সাথে সাধারণ মানুষের কথা হয়েছে। সবাই বলেছেন, তারা ভোট দিতে চান। তবে যেভাবে ক্ষমতসীনদের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি এসে হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে তাতে তারা খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একইসাথে পুলিশও নানা হুমকি দিচ্ছে।

ফেনী সদরে (আসন-২) এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সাথে। কেউই তাদের পরিচয় জানাতে রাজি হননি। তারা জানান, ভোট কেন্দ্রে না যেতে আমাদের প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধভাবে ইউনিয়নের বিভিন্নস্থানে ঘুরাঘুরি করছে। এই আসনের লেমুয়া বাজারে একই অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা। ফেনী শহরেও আ’লীগ নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিচ্ছে বলে ভোটাররা জানান। কথা হয় (ফেনী-৩) আসনের দাগনভূইয়া এলাকাতেও। সেখানেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা অলি-গলিতে মহড়া দিচ্ছে। কুমিল্লার লাঙ্গলকোর্টে দেখা যায় একইচিত্র। শনিবার দুপুরে উপজেলা চেয়ারম্যানকে ২০-২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় মহড়া দিতে দেখা গেছে। এছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে বৈঠক, মিছিল করছে নৌকার প্রার্থীরা। শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা-১ (নবাবগঞ্জ-দোহার) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সালমান এফ রহমান উপজেলার বক্সনগর ও বাহ্রা ইউনিয়নে ১২টি উঠান বৈঠক করেন।

এ ব্যাপারে নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা মো. সাইবুর বলেন, এখন উঠান বৈঠক কিংবা প্রকাশ্যে কোনো জনসভা করা যাবে না। যদি কোনো মনোনয়নপ্রত্যাশী এ ধরনের কাজ করে থাকেন, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সালমান এফ রহমানের উঠান বৈঠক সম্পর্কে তিনি অবগত নন বলে জানান। অথচ সালমান এফ রহমান প্রকাশ্যে মিডিয়ার উপস্থিতিতে বৈঠক করেছেন।
অভিযোগে প্রকাশ, শুধু কয়েকটি জেলা বা আসনেই নয়, হুমকি-ধামকি আর গ্রেফতারের চিত্র দেশের সব ক’টি আসনেই। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এসব অভিযোগ জাতির সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। একইসাথে নির্বাচন কমিশনেও জানানো হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, কোথাও বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা এলাকায় থাকতে পারছে না। এমনকি সাধারণ মানুষও ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ভয়ে তটস্থ থাকেন। ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি পুলিশের গ্রেফতার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, কোথাও গ্রেফতার করা হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিনই বিএনপি নির্বাচন কমিশনে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের তালিকা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিকার নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে অবনতি অব্যাহত আছে সেটি আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনে রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশে নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা সংক্রান্ত ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, সবার জন্য আইনের সমান প্রয়োগ না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তিনি বলেন, নিরপেক্ষভাবে আইনের প্রয়োগ না করলে সে আইন, আইন নয়, কালো আইন। সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ না করলে সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, সব রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। সারা জাতি এই নির্বাচন নিয়ে উদ্দীপ্ত, উচ্ছ্বসিত। এই উদ্দীপনাকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ সভায় তফসিল ঘোষণার আগে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, তফসিল ঘোষণার পরে তাদের পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন কতটা সম্ভব এই প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ না হলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। মাহবুব তালুকদার বলেন, গাজীপুরে নির্বাচনকালে ইউনিফরমধারী পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ অনেক ব্যক্তিকে বাসা থেকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। অনেককে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের একজন ছাড়া পুলিশ অন্যদের গ্রেফতারের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি করেনি। নির্বাচনের পর দেখা যায় তাদের ১০ জনকে অন্তত কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাওয়া গেছে। মাহবুব তালুকদার বলেন, গ্রেফতার না করলে তারা কারাগারে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত গায়েবি মামলা প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, বর্তমানে বহুল প্রচলিত গায়েবি মামলা এখন আর গায়েবি আওয়াজ না। হাইকোর্ট পর্যন্ত এ ধরনের মামলাতে পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় বলে উল্লেখ করেছেন। ঢাকার পুলিশ কমিশনার পুলিশ বাহিনীকে গায়েবি মামলা না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে এরূপ মামলা চালু রয়েছে।

সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষণ গণনা চলছে। সম্ভাব্য প্রার্থীও চূড়ান্ত। তবে সরকারি দল ও পুলিশ প্রশাসনের আচরণে নির্বাচন কেমন হবে- তা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে চলছে আলোচনা। পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটায় অনেকের আশঙ্কা করছেন, সরকারি দলের আবারো ক্ষমতায় থাকার অবিব্যক্তিতে আবারো দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
দেশব্যাপী ক্ষমতাসীনদের আচরণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেছেন জাতীয় ঐক্যের আহ্বায়ক গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা নিরপেক্ষ হচ্ছে না। তাই তার জায়গায় অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া হোক। আর তা না হলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব। ড. কামাল বলেন, যারা আদিষ্ট হয়ে কাজ করে তারা সংবিধান লঙ্ঘন করছে। এদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এই সিইসির অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তারপরও আমরা শেষপর্যন্ত দেখতে চাই। যদিও সরকার নানা অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। বিনা কারণে, বিনা অপরাধে গ্রেফতার, অন্তরীণ চলছে। দেশব্যাপী হুমকি-ধামকি অব্যাহত রয়েছে। ড. কামাল বলেন, আমরা সুশাসন চাই, গণতন্ত্র চাই। সুষ্ঠুভাবে জনগণ যাতে ভোট দিতে পারে সেই পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। এতদিন যা হয়েছে আমরা তা মেনে নিয়েছি। এখন থেকে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সরকারকে নিতে হবে। তা না হলে আমরা কঠিন পদক্ষেপ নেব।

দেশে এখনো নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ গড়ে উঠেনি বলে মত দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন কি অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য হবে, না কি ২০১৪ সালের মতই ত্রুটিযুক্ত এবং ব্যথ' হবে, এটাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও সেটা কি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে?
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, নির্বাচন ঘিরে যা ঘটছে তা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন সুপ্রিম কোর্টের সামনে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসছেন জামিনের জন্য। তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি বাদ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আসতে হচ্ছে জামিনের জন্য। যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলো কী ধরনের মামলা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কোনো দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর কোনো দলের নেতাকর্মীরা আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন- এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের হঠাৎ সিদ্ধান্ত, বিপুল ব্যয় এবং অনমনীয় অবস্থান প্রশ্নের উদ্রেক করে। নির্বাচন কমিশন যদি প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকা- করে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। যেটা নির্বাচন কমিশনের বলার কথা, সেটা আগেই সরকার কিংবা সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলে দিচ্ছেন- এগুলো মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা ভয়াবহ সংকটে আছি। সংকটের কারণেই অনেক দিন পর সব দল নির্বাচনে অংশ নিলেও সেই নির্বাচন প্রতিদ্বন্ধিতামূলক হবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যেহেতু দলীয় সরকার এবং সংসদ বহাল রয়েছে, সে কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমতল ক্ষেত্র তৈরি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, যে রাজনীতিবিদরা তাদের সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে লেখাপড়া করান এবং বিদেশের নাগরিক হতে উদ্বুদ্ধ করেন, তাদের এ দেশে এমপি-মন্ত্রী হওয়া কতটা নৈতিক তা বিবেচনা করা জরুরি। মাদক ব্যবসার অভিযোগ ওঠায় আবদুর রহমান বদিকে মনোনয়ন না দিয়ে তার স্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়ারও কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়রম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার জন্য ঢালাওভাবে বিএনপিকে দায়ী করা হয়। অথচ তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তিনি সে সময় ঘরের বাইরেই বের হননি। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ২২টি মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি সে সময়ের সহিংস ঘটনার নেপথ্যে প্রকৃতপক্ষে কারা ছিল, তা বের করার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা তার ভেতরে নির্বাচন কমিশনকে যতই স্বাধীন করা হোক, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এখনো প্রতিনিয়ত আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন পুলিশের সামনে তাদের মিটিংয়ের মধ্যে। দ্যাট ইজ এনাফ। প্রত্যেকটি দল, সুশীল সমাজ, যারা নির্বাচনী কাজ করছে তারা সবাই বলছেন যে, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রমাণ করবার জন্য এমন কিছু কাজ করতে পারেনি। আমরা গায়েবী মামলার তালিকা দিলাম এখন পর্যন্ত তারা কিছুই করতে পারেনি। আমরা যে সমস্ত কর্মকর্তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলাম, সে সম্পর্কে সিইসি বলে দিয়েছেন বদল হবে না। সিইসি অত্যন্ত মারাত্মক কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, আমাদের অধীনে আছে, যা করছে আমাদের নির্দেশেই করছে। তাহলে যত গায়েবী মামলা, যত হয়রানি সব তাদের নির্দেশে হচ্ছে। তাহলে তো লেভেল প্ল্যায়িং ফিল্ড তৈরি হলো না। তার পরেও আমরা নির্বাচনের কাজ করছি এবং শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই করে যাবো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি ড. কামাল হোসেন ঘোষণা দিয়েছেন যে, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবে না। এ ঘোষণা আমাদেরকে আশাবাদী করেছে যে, আগামী ৩০ ডিসেম্বর সব দলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখনও শঙ্কা থেকে যায়- নির্বাচনটি কি প্রতিদ্বন্ধিতামূলক হবে? এর ফলাফল কি গ্রহণযোগ্য হবে? তারা বলেন, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করার পথে অনেকগুলো পর্বতপ্রমাণ বাধা রয়েছে। প্রথম বাধা হল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। আমরা দেখেছি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানির মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘরছাড়া করেছে, যেভাবে দলটির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে তাতে তথাকথিত ‘খুলনা মডেল’র নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনই হবে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি যেভাবে দমন-পীড়ন ও হয়রানি, গ্ােয়বি মামলা চলছে, তা কোনো সভ্যসমাজে ঘটে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে দ্বিতীয় বাধা হল সংসদ বহাল থাকা। সংবিধান আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদেরকে ‘আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’ প্রদান করলেও, সংবিধান এবং উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে তারা স্থানীয় উন্নয়নেই বেশি মনোযোগী। আর স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে তারা স্থানীয়ভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। অনেক এলাকায় সংসদ সদস্যের অনুমতি ছাড়া তাদের নির্বাচনী এলাকায় এমনকি গাছের পাতাও নড়ে না। তাই সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে নির্বাচনী মাঠ অসমতলই থেকে যাবে, কারণ সংসদ সদস্যদের পক্ষে অতি সহজেই নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করা সম্ভব হবে। তাদেরকে নির্বাচন প্রভাবিত না করার কথা বলা হলেও তারা যে তা শুনবেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। নির্বাচনের সময়ে কমিশন রেফারির ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের বর্তমান কমিশন গত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও কমিশনের ভূমিকা বহুলাংশে প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে তফসিল ঘোষণার পর তাদের গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীর তালিকা কমিশনকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশন এ তালিকা নিয়ে কিছুই করেনি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন নেতাকমীরা মিছিল ও শোডাউন করে ঢাকা মহানগরের একাংশকে অচল করে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে, যাতে কমিশন কোনো বাধা প্রদান করেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হওয়া অতি জরুরি। তা না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করার কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে। এর পাশাপাশি আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে হলি আর্টিজানের জঘন্য আত্মঘাতী হত্যাকারীদের মতো বিপদগামী হয়ে যেতে পারে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমন অবস্থা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

http://www.dailysangram.com/post/354779