২৫ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:৩৯

বহির্গমন ছাড়পত্রের নামে জালিয়াতি

বিএমইটি থেকে দুদকের অস্থায়ী ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হয়েছে

বিদেশগামী কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়ার নামে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অভ্যন্তরে চলছে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি। কখনো কখনো কৌশলে নেয়া হচ্ছে জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ও। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে বিদেশে যাওয়ার পর হাজার হাজার কর্মীকে।
দীর্ঘদিন ধরে বিএমইটির বহির্গমন শাখায় জালিয়াত চক্রের সদস্যদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রের সদস্যরা হাইকমিশন/দূতাবাসের যাচাই-বাছাইকে পাত্তা না দিয়ে নিয়ম-বহির্ভূত কার্যক্রম চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপরও এসব ঘটনার সাথে জড়িতরা রহস্যজনক কারণে রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

যদিও এসব অবৈধ ধান্ধা প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের শনাক্ত ও হাতেনাতে ধরতে কিছুদিন আগেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে (বিএমইটি) অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই সেই ক্যাম্পটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এর পর থেকেই চক্রের সদস্যরা আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পিপি টেকনোলজি এসডিএন-বিএইচডি নামক কোম্পানিতে কর্মী পাঠাতে ঢাকার ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির একটি রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল ৫২ জন কর্মীর সত্যায়ন নেয়ার জন্য মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে জমা দেয়। হাইকমিশনের কর্মকর্তারা পিপি টেকনোলজি কোম্পানি ভিজিট করে জানতে পারেন, এসব কর্মীর নামে সত্যায়ন দেয়া হলে তারা এসে বিপদে পড়ে যাবেন। এরপর ওই ফাইল হাইকমিশনে পড়ে ছিল কিছুদিন। অনেক চেষ্টার পরও যখন হাইকমিশন থেকে এজেন্সির প্রতিনিধিরা সত্যায়ন করাতে ব্যর্থ হয়, তখনই তারা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বহির্গমন শাখার জালিয়াত চক্রের সাথে যোগাযোগ করে বহির্গমন ছাড়পত্র নেয়ার চেষ্টা করে। এতে তারা সফলও হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকমিশনের সত্যায়ন ছাড়াই এক এজেন্সির কাজ অন্য এজেন্সির নামে জমা দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রথমে ২৭ জনের নামে স্মার্টকার্ড বের করে মালিক তাদের মালয়েশিয়ায় পাঠাতে সক্ষম হন। একইভাবে বাকি কর্মীর কাগজপত্র জমা দেয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিছুদিন পর করে দিতে পারবেন বলে এজেন্সির প্রতিনিধিকে আশ্বস্ত করেন। প্রায় দুই সপ্তাহ অপেক্ষার পর ‘টেস্ট কেইস’ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার একজন শ্রমিকের নামে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করাতে সফল হন। এখন তারা সুযোগ বুঝে বাকি ২৪ জন শ্রমিকের নামে বহির্গমন ছাড়পত্র নেয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ব্যুরোতে ফাইল আজ অথবা কাল জমা দিতে পারেন। হাইকমিশনের সত্যায়ন নেই, তারপরও রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল ব্যুরোর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে যে শ্রমিকের নামে বহির্গমন ছাড়পত্র (স্মার্টকার্ড) ইস্যু করিয়েছেন তার নাম মো: তারেকুল ইসলাম। পিতার নাম মো: ইসাহাক মোল্লা। রেজিস্টার্ড আইডি পিটিএম২০১৮০৪২৩৩০১জি, পাসপোর্ট নম্বর বিটি০০৬০১০৪। আরএল নম্বর ০২৫৮, ক্লিয়ারেন্সের তারিখ-২২-১১-২০১৮।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর একজন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, শুধু মালয়েশিয়ার পিপি টেকনোলজির নামেই যে সত্যায়ন ছাড়া বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু হচ্ছে তা কিন্তু নয়, প্রতিদিন নানা কৌশলে বিএমইটিতে গড়ে ওঠা চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এজেন্সির লাইসেন্সের নম্বর ব্যবহার করে অনিয়ম, দুর্নীতি আর জালিয়াতির ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছে। এমনো অভিযোগ আছে, জালিয়াতির পর যাত্রী ফ্লাইটে ওঠার পর অনলাইন ডাটা থেকে কর্মীর নাম-নিশানা মুছে ফেলা হচ্ছে? যদিও ফাইনালি এসব গুরুতর অনিয়ম দেখার কথা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের। কিন্তু তারাও এসব না দেখার ভান করে থাকেন অনেক সময়। এ প্রসঙ্গে বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক তানভীর হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, সত্যায়ন ছাড়া কর্মী যাওয়ার বিষয়টি তার দেখার বিষয় নয়। এটি দেখার দায়িত্ব জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখার।

অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রতিবাদকারী ভুক্তভোগী একজন ব্যবসায়ী গতকাল এ প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি বলেছি, হাইকমিশনের সত্যায়ন ছাড়া আমার কোনো লোক মালয়েশিয়ায় যাবে না। কিন্তু জালিয়াত চক্রের সদস্যরা আমার সাথে চ্যালেঞ্জ করে বিএমইটির বহির্গমন শাখার সংশ্লিষ্টদের ২০-২৫ হাজার টাকায় ম্যানেজ করে একজনের নামে স্মার্টকার্ড বের করে নিয়ে এসেছে বৃহস্পতিবার। অথচ আমি যতটুকু জানি, মালয়েশিয়ার পিপি টেকনোলজি কোম্পানিতে যাওয়া কর্মীদের থাকাসহ অনেক সমস্যা আছে। তা ছাড়া পাইপ ফ্যাক্টরির কাজে গরম বেশি। কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যার কারণে হাইকমিশন থেকে এসব কারণে কর্মীদের নামে অ্যাটাসটেশন দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য লাইসেন্সের নামে (১২০২ নম্বর-আরএল) গত ১১ নভেম্বর ২৭ জনের বহির্গমন ছাড়পত্র টাকার বিনিময়ে বের করেন। অ্যাটাসটেশন ছাড়া কিভাবে করল বিএমইটি? এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল গতবার অন্য এজেন্সির নামে ছাড়পত্র নিলেও এবার তারেকুল ইসলাম নামের এক কর্মীর স্মার্টকার্ড নিয়েছে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামেই। যদিও এটা নিয়মবহির্ভূত। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিএমইটির যদি কেউ জড়িত থাকেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। শুধু পিপি টেকনোলজি নয়, একইভাবে গত সপ্তাহে অপর আরো একটি রিক্রুটিং এজেন্সির নামে ৭০ জন কর্মীকে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। পরে ওই কর্মীরা মালয়েশিয়ায় উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। এই কর্মীর ক্ষেত্রেও মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে কোনো ধরনের সত্যায়ন নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। গত রাতে রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এর আগে বিকেলে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বহির্গমন ছাড়পত্র জালিয়াতির মাধ্যমে (স্মার্টকার্ড) ইস্যু প্রসঙ্গে ব্যুরোর পরিচালকের (বহির্গমন) সাথে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ না করে টেলিফোন লাইন কেটে দেন।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/367145