২৪ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১১:৫৩

মামলার হাজিরায় দিশাহারা কোটা আন্দোলনের নেতারা

একের পর এক মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে দিশাহারা কোটা আন্দোলনের নেতারা। মাসের নির্দিষ্ট কয়দিন কাটাতে হয় আদালতের বারান্দায়। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথমসারির নেতারা কোর্টে হাজিরার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ সরকারের কাছে তাদের মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন।

কোটা আন্দোলনের নেতা রাশেদ খান বলেন, আমার নামে একাধিক মামলা রয়েছে। সবগুলোই মিথ্যা মামলা। আমাদের প্রতি মাসেই হাজিরা দিতে হয়। মামলার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে কারো মাসে একবার কারো দুবার হাজিরা দিতে হয়। এর ফলে আমাদের মাঝে মানসিক একটি প্রেসার থাকে আদালতে গেলে আমাদের আবার গ্রেপ্তার করবে কি না।
মামলার চার্জশিট জমা দেয়ার কথা থাকলেও পুলিশ এখনো তা জমা দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো ধরনের নিরাপত্তা দেয়া হয়নি। তাই ক্লাস, পরীক্ষা ও প্রেজেন্টেশনে অংশ নিতে পারি না। আমাদের জীবনটা এখন মামলা আর হাজিরানির্ভর হয়ে গেছে। মামলার হাজিরার দু-একদিন আগে থেকেই মানসিক একটি চাপ ও অশান্তি কাজ করে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। সারাক্ষণ মনে হয় পেছন থেকে এই বুঝি আমাদের কেউ অনুসরণ করছে। যাদের মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা, তাদেরও হয়তো গ্যাপ পড়ে যাবে। পাশাপাশি মামলার খরচ চালাতে হয় আত্মীস্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য ও ধার-দেনা করে।

কোটা আন্দোলনের প্রথমসারির নেতা নুরুল হক নুর বলেন, আমার নামে কোনো মামলা নেই। তবে অন্য নেতাদের নামে দেয়া প্রত্যেকটি মামলাই মিথ্যা এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিয়েছে ১টি এবং শাহবাগ থানা দিয়েছে ৩টি মামলা। প্রথমদিকে সবগুলো অজ্ঞাতনামা মামলা দেয়া হয়। দীর্ঘদিন এই মামলা তদন্তাধীন ছিল। এরপর এক আলোচনা বৈঠকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকার পক্ষ স্পষ্টভাবে বলেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই হামলার সঙ্গে জড়িত নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই মামলায় কোনো ছাত্রকে জড়ানো বা হয়রানি করা হবে না। এর পরও ছাত্রদের নামে মামলা করা হয়েছে। পরীক্ষার দিন ছাত্রদের কোর্টে হাজিরা থাকে। ঢাকার বাইরে থেকে যারা হাজিরা দিতে আসে, তাদের দুর্ভোগের অন্ত নেই।

আমরা খুব হতাশ এবং বিস্মিত যেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে ছাত্রদের পক্ষে কথা বলছে। সেখানে সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এবং প্রধান বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট তাদের ৭টি দাবির মধ্যে প্রধান দাবি হিসেবে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জোর দাবি জানিয়েছে। তাছাড়া আমরা যারা এই আন্দোলনটা করেছি, তারা অধিকাংশই সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন থেকেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি। এই মামলার সঙ্গে ছাত্রদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শুধু ছাত্রদের আন্দোলন বন্ধ করতে এবং ভয় দেখাতে মামলাগুলো দেয়া হয়েছে। ছাত্রদের ভয়ভীতি দেখাতে এবং অন্যদের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে মামলাগুলো জিইয়ে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার মন্ত্রীরা বলেছেন, তারা তরুণবান্ধব সরকার। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমাদের আগামী নির্বাচনের টার্গেট হচ্ছে তরুণ এবং নারী ভোটার। তাই আমরা সরকারের কাছে প্রত্যাশা করবো কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রদের নামে মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হোক।

কোটা নেতা মশিউর রহমান বলেন, আমি মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। আমার নামে একটি মামলা হয়েছে। তিন মাস আগে জেল থেকে বেরিয়েছি। গত তিন মাসের মধ্যে যে দুদিন আমি হাজিরা দিয়েছি, ওই দুদিনই আমার পরীক্ষা ছিল। একই তারিখে যদি পরীক্ষা এবং হাজিরা থাকে তাহলে কোনটার গুরুত্ব আমার কাছে বেশি? নিশ্চয় আগে পরীক্ষা, পরে হাজিরা। কিন্তু পরপর দুবার যদি হাজিরা না দিই, তাহলে আমার নামে ওয়ারেন্ট চলে আসবে। আমাকে আবারও কারাগারে যেতে হবে। কাজেই এখন আমার কাছে মামলার হাজিরার গুরুত্ব অনেক বেশি। যারাই শোনে আমরা কোটা নেতা, তারাই বলে আপনি তো শেষ। আপনার ক্যারিয়ার শেষ। আমরা কোনো সুবিধা বা সরকারি চাকরির আশায় আন্দোলনে নামিনি।

যেহেতু আমাদের নামে করা মামলাগুলো মিথ্যা এবং বানোয়াট, তাই মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী তরুণদের নিয়ে আশাবাদী তরুণরা তাদের পক্ষে থাকবে। তরুণদের কাছে তিনি ভোট চেয়েছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন আমাদের নামে করা মিথ্যা মামলাগুলো যেন অচিরেই প্রত্যাহার করা হয়।

ভাওয়াল বদরুল আলম সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও কোটা আন্দোলন নেতা রাতুল সরকার বলেন, আমার নামে দুটি মামলা রয়েছে। একটি সাইবার ক্রাইম, অন্যটি পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার মামলা। এখন আমার মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। চলতি মাসের ১ তারিখ হাজিরা, ২ তারিখ একটি প্রোগ্রাম ছিল, ৪ তারিখ পরীক্ষা- তার মানে মাঝে পড়ার জন্য একদিন সময় পেয়েছিলাম। এরপর আবার হাজিরা। এ অবস্থায় পড়ালেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই খারাপ প্রভাব পড়ছে। এগুলোর জন্য আমাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। আমার বাসা যেহেতু গাজীপুর, তাই সেখান থেকে প্রতি মাসে দুবার হাজিরা দিতে সময় ও অর্থ খরচের একটি বিষয় আছে। আমরা সবাই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমরা চাই, আমাদের নামে করা এই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ দেয়া হোক।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী পিএম সুহেল বলেন, যেদিন মামলার হাজিরা থাকে তার আগের দিন টেনশনে আমরা শেষ হয়ে যাই। হাজিরা দিতে গিয়ে আবার আটকে দেয় কি না? প্রতিমাসে হাজিরা দিতে কার ভালো লাগে? এটা নিয়ে পরিবারের যেমন দুশ্চিন্তা তেমনি নিজেরও দুশ্চিন্তা থেকে যায়। পরীক্ষা থাকলে সেক্ষেত্রে পরীক্ষা বাদ দিয়ে হাজিরা দিতে যেতে হয়। মামলা থাকলে যে কারোরই স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। মাথার মধ্যে একটি বোঝা মনে হয় এ মামলাকে। সবসময় একটি ভয়ের মধ্যে থাকি, কখন কী হয়। জামিন হয়েছে, তার পরেও মনে হয় আমাদেরকে আবার ধরে নিয়ে যায় কি না? দরজায় কেউ টোকা দিলে মনে হয়, কেউ আসছে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। একটি মানসিক ট্রমার মধ্যে আছি। এছাড়া মামলার হাজিরা ও পরিবহন খরচ আমাদের নিজেদেরকেই বহন করতে হয়। আমরা তো দোষী না। তাই আমরা চাই, আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে যারা দোষী তাদেরকে শাস্তি দেয়া হোক।

 

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=146468