২৪ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১১:৪০

অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে জাতীয় নির্বাচনের ব্যয়

ইসির ব্যয় বাড়লেও প্রার্থীর ব্যয়সীমা স্থিতিশীল * একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরাদ্দ ৭৩২ কোটি টাকা * বরাদ্দের প্রায় ৬৫ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা খাতে * ব্যয় স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে : ইসি মো. রফিকুল ইসলাম


জাতীয় নির্বাচনের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। পাঁচ বছরে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির তুলনায় এটা বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বাজেট ছিল প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সব আসনে নির্বাচন না হওয়ায় ব্যয় হয় ২৮৩ কোটি টাকা। এবারের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখন পর্যন্ত ব্যয় ধরেছে ৭৩২ কোটি টাকা। ইভিএম কেনার খরচ এ বাজেটের মধ্যে নেই।
এদিকে ইসি নির্বাচনের ব্যয় বাড়ালেও প্রার্থীদের ব্যয়সীমা একই রাখা হয়েছে। ২০১৪ সালের মতোই প্রার্থীর ব্যয়ের সীমা ২৫ লাখ টাকা। তবে ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ৮ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা করা হয়েছে। অথচ মূল্যস্ফীতির হিসাবে পাঁচ বছরে টাকার মূল্য কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ। সেই হিসাবে ভোটারপ্রতি ব্যয় ও প্রার্থী ব্যয়ের সিলিং আরও বাড়তে পারত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গত বছর ১৪৭ আসনে নির্বাচন হয়েছিল। এবার ৩০০ আসনেই হচ্ছে। তাই ব্যয় দ্বিগুণ হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া এই ৫ বছরে নির্বাচনী সামগ্রীর দাম কমবেশি বেড়েছে। সুতরাং ব্যয় স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ১৯৮ দশমিক ১৫ টাকায় যে পরিমাণ কেনাকাটা করা যেত, ২০১৮ সালের অক্টোবরে একই কেনাকাটায় লেগেছে ২৫৯ দশমিক ১৩ টাকা। অর্থাৎ একই কেনাকাটায় ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬১ টাকা। এটা ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশের সমান। অপরদিকে একই সময়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যয় বাড়ছে ২৩২ কোটি টাকা। এ ব্যয় বৃদ্ধির হার ৪৬ শতাংশের বেশি।
নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনী ব্যয়ে পাগলা ঘোড়ার এই গতি অবশ্য এবারই অস্বাভাবিক নয়। এর আগের নির্বাচনগুলোর একটি আরেকটির রেকর্ড ভেঙেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যয়ের পার্থক্য ছিল চতুর্থ ও পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে। চতুর্থ নির্বাচনে ব্যয় ছিল ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পঞ্চম নির্বাচনে প্রায় ৫ গুণ বেড়ে হয়েছিল ২৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনে ইসির অনুকূলে বরাদ্দ ব্যয়ের সিংহভাগই চলে যায় আইনশৃঙ্খলা খাতে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা ঠেকানোসহ নানা কৌশলগত কারণে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ও থাকে। শান্তিপূর্ণ ও সহমতের নির্বাচন হলে এ ব্যয় বৃদ্ধির লাগাম এতটা বেশি হতো না বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
ইসি কর্মকর্তাদের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে ব্যয় ছিল মাত্র ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। তখন ভোটার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ। দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় বেড়ে যায় তিন গুণ। ওই নির্বাচনে মোট খরচ হয়েছিল ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। তৃতীয় নির্বাচনে ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া ষষ্ঠ সাধারণ নির্বাচনে ৩৭ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয় ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং নবম জাতীয় নির্বাচনে মোট ব্যয় ছিল ১৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যদি ভোটার ও কেন্দ্র সংখ্যা বেড়ে থাকে, তাহলে ব্যয় বাড়তেই পারে। আমার তো মনে হয়- এবার ব্যয় আরও বাড়বে। নিরাপত্তার জন্য যদি ৬৫ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়ে থাকে, তাহলে তাতে হবে না। মোট বাজেটের কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হবে। এই ব্যয়টা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে না। কেননা, গণতন্ত্র কোনো সস্তা জিনিস নয়। সুতরাং এর জন্য ব্যয় করতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রার্থীর ব্যয় কত টাকা ধরা হল তা খুঁজে কোনো লাভ নেই। আমার তো মনে হয়, ৫ কোটিতেও একজন প্রার্থীর নির্বাচন উঠে না। জাতীয় স্বার্থে প্রার্থীর ব্যয় দমিয়ে রাখতে হবে। এর জন্য ইসিকে ব্যয় মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল বের করতে হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১১টি নির্বাচনের মধ্যে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন অনেক ঘটনাবহুল। বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে ওই নির্বাচন ঠেকানোর কর্মসূচি ছিল। আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রথমে ৫শ’ কোটি টাকা বাজেট ছিল। ওই বছর ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ফলে ওইসব সংসদীয় আসনে ইসিকে ভোটের আয়োজন করতে হয়নি। বাকি আসনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে মোট ব্যয় ছিল হয় ২৮৩ কোটি টাকা। এ নির্বাচনে দেশের মোট ভোটার ছিল প্রায় ৯ কোটি ১৯ লাখ। সপ্তম নির্বাচনে অবশ্য ষষ্ঠ নির্বাচনের তুলনায় ব্যয় কম হয়েছে।
জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় হয় ২০০ কোটি টাকার কিছু কম। এবার ওই খাতে ৪৩০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এটি এবারের নির্বাচনে বরাদ্দের প্রায় ৬৫ শতাংশ। এ ব্যয়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর জন্য ৪৫ কোটি, আনসার সদস্যদের জন্য ১৯০ কোটি, পুলিশের জন্য ১৬৫ কোটি এবং র্যা ব ও বিজিবির জন্য ৩০ কোটি টাকা রয়েছে। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে পুলিশ হেডকোয়ার্টার বলেছিল, ভোট কেন্দ্র ও জনবল বৃদ্ধি, যাতায়াত খরচ দ্বিগুণ হওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়া।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার ইসি প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে। ইভিএম প্রকল্পে সরকার আংশিক বরাদ্দ করেছে। তা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের ব্যয় শেষ পর্যন্ত এক হাজার কোটি টাকায় ঠেকতে পারে। কেননা, অদৃশ্য আরও বেশকিছু খাত আছে। যেমন- সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে নির্বাচন ঘিরে নাশকতামূলক তৎপরতার আগাম আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
ওইসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যাপক প্রস্তুতিমূলক কাজ করছে। তাদের কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বাড়ানোর ফলে ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে অতিরিক্ত আর্থিক চাপ মেটাতে ‘বিশেষ বরাদ্দ’ হিসেবে ৩০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ওই বরাদ্দের অনুমোদন প্র্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, এবার সারা দেশে ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ। সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার ১৯৯টি সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ৪০ হাজার ১৯৯ জন প্রিসাইডিং অফিসার, প্রায় ৮০ হাজার সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পাঁচ থেকে ছয় লাখ পোলিং অফিসারসহ প্রায় সাত লাখ নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মী এবং ৫ লাখ আনসার সদস্য দেশব্যাপী নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত থাকবেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/114792