২৪ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১১:৩২

শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য রুখে দেয়া জরুরি

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : একশ্রেণির শিক্ষাবণিক সারাদেশে শিক্ষা নিয়ে জমজমাট পসরা বসিয়েছেন। শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অবধি শিক্ষাবণিকরা অশুভ তৎপরতায় মেতেছেন। এমনকি এমফিল ও ডক্টরাল তথা পিএইচ.ডি ডিগ্রি প্রদান নিয়েও বাণিজ্য চলে। টাকা হলেই হলো। গবেষণা, থিসিস কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এমনটা যে কেবল আমাদের দেশে তা নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের বিপণি খুলে বসেছেন অনেকে। ঘরে বসে থেকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন আজকাল কোনও ব্যাপারই না। অর্থের পরিমাণটা একটু ওজনদার হলেই চলে। ব্যস, কেল্লাফতে।

আমরা আগে পড়েছিলাম, 'ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ।' অর্থাৎ অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা। ছাত্ররা সাধনা করে বিদ্যা লাভ করবে। তবে সেদিন এখন বাসি। আজকাল ছাত্ররা যেমন পড়ে না। শিক্ষকরাও পড়ান না। মানে পড়তেও হয় না। পড়াতেও হয় না। যেমন শিক্ষক। তেমন ছাত্র। যেইসা গুরু। তেইসা শিষ্য। শিক্ষা মানুষের মৌলিক এবং মানবিক অধিকার। এর প্রতি যেমন অভিভাবকের দায়িত্ব থাকে, তেমনই যারা দেশ এবং সমাজ পরিচালনা করেন তাঁদেরও করণীয় থাকে। শিক্ষা নিজে নিজে বিকশিত হয় না। এর পেছনে অনেকের অবদান থাকে। ত্যাগ ও পরিশ্রম থাকে। উল্লেখ্য, একাডেমিক শিক্ষার একটা বয়স আছে। সাধারণত ৪ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে শিশুদের একাডেমিক শিক্ষা শুরু হয়। এ শিক্ষার ধারাবাহিতা ৩০ অথবা তার ২/১ বছর আগেই শেষ হলে ভালো হয়। এরপর সরকারি চাকুরির পেছনে দৌড়ঝাঁপ শুরু করতে হয়। কিছুদিন থেকে অবশ্য চাকুরি শুরুর বয়সসীমা ৩৫ বছর করবার আন্দোলন শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাজীবন শেষ হতে আজকাল যেসময় লাগে তাতে এ দাবি অনেকটাই যৌক্তিক। কিন্তু কর্তৃপক্ষের তেমন সাড়াশব্দ নেই বললেই চলে। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যতীত আমাদের দেশে শিক্ষা তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করলেই চাকুরি পাবার আশাও নেই। তাই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দেশে বেড়েই চলেছে প্রতিবছর। এ সমস্যা সমাধানে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সাধারণ শিক্ষা দিয়ে বেকারত্বের বোঝা বাড়িয়ে লাভ কী?
দেশে মানসম্মত শিক্ষার অভাব তীব্র। তারপর প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই। তাই একশ্রেণির শিক্ষাবণিক যেখানেসেখানে কিন্ডারগার্ডেন, ইংলিশ মিডিয়ম, নার্সারি স্কুল, বাহারি নামের কলেজ, ভার্সিটি খুলে বসেছেন। এগুলোর বেশিরভাগেই মানসম্মত শিক্ষা দেবার জন্য দক্ষ শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। এমনকি শিক্ষার পরিবেশ ও ক্লাসরুমও নেই। অথচ ভর্তি ও টিউশন ফি'র জন্য প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয় অভিভাবকদের কাছ থেকে। ঢাকার শুধু ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও থানা এলাকাতেই একটু পরপর বিভিন্ন আবাসিক ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোতে না আছেন উপযুক্ত শিক্ষক, না রয়েছে শিক্ষাউপকরণ। খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, এমনকি খোলামেলা ক্লাসরুমও নেই। কোনওরকমে চিপা গলিপথে ঢুকতে হয় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এগুলো থেকে যেমন উপযুক্ত শিক্ষা পায় না কোমলমতি শিক্ষার্থীরা, তেমনই তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দেবার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তা নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই আদৌ। বরং শিক্ষার নামে বাণিজ্যিক মানসিকতাই কাজ করেছে এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপনে। উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না পেয়ে অসহায় অভিভাবকরা এগুলোতেই ভর্তি করাতে বাধ্য হন তাদের প্রিয় সন্তানদের।

বাণিজ্যিক মানসে প্রতিষ্ঠিত এসব স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় যেমন গলাকাটা অর্থ আদায় করা হয়, তেমনই টিউশন ফিও নেয়া হয় মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা। আবার পিএসসি, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময়ও নেয়া হয় ৫ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা। অথচ বোর্ড ফিস খুব সামান্যই বলা চলে। কোথায় যায় এতো টাকা? কেন নেয়া হয় অভিভাবকের গলাকাটা এই অর্থ? অন্য বারের মতো এবারও এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের জন্য অতিরিক্ত অর্থ নেবার অভিযোগ উঠেছে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। কোনও কোনও স্কুলে দুদকের টিম অভিযান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে। অতিরিক্ত ফিস আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনুমোদন ও এমপিও বন্ধ করে দেবার হুমকি দেয়া হয়েছে। এরপরও অতিরিক্ত ফিস আদায় বন্ধ হয়েছ তা বলা যায় না।

প্রাইভেট মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হলেতো কোনও কথা নেই। শুধু ভর্তির সময়ই নেয়া হয় ২৫/৩০ লাখ করে টাকা। তারপর বিভিন্নভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনও সন্তান মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে এতো টাকা জোগাড় কি চাট্টিখানি কথা?
প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে: নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষের সন্তানের লেখাপড়ার পথ রুদ্ধ হবার উপক্রম। এমনকি মধ্যবিত্তরাও সন্তানের পড়ালেখার ব্যয়ভার নিয়ে এখন চিন্তিত। তাই শিক্ষার কোনও পর্যায়েই বাণিজ্যিক প্রবণতা থাকা উচিত নয়। দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে শিক্ষাবণিকদের এই দুর্বিনীত দৌরাত্ম্য রুখতেই হবে। এর কোনও বিকল্প নেই।

http://www.dailysangram.com/post/354515