২৩ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ২:১৫

ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অসমর্থ তা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: নির্বাচন কমিশন (ইসি) সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যে মোটেও সমর্থ নয় এটি দেশে বিদেশে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরা নিজের কথা নিজেরাই রাখতে পারছেন না। ইসি বলেছিল, সারাদেশে যে সব ব্যানার পোস্টার ও বিলবোর্ড ছিল সেগুলো নামাতে হবে। কিন্তু দুই দফা নির্দেশের পরও সেগুলো নামনো হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এসব নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখনো সব কিছুই প্রায় বহাল তবিয়তের আছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, নির্বাচন কমিশনে জানানো কোনো অভিযোগের প্রতিকার নেই। এমনকি উল্টো যারা অভিযোগ করছেন তাদের হেনস্তা হতে হচ্ছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল ও জোট বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বারবার অভিযোগ দিলেও সেগুলো আমলে নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। অথচ নির্বাচন খুবই সন্নিকটে। এছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে তা এখনো বহাল রয়েছে। প্রশাসনের অনেকেই ক্ষশতাসীন আ’লীগের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অনেকেই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন কর্মকর্তাদের বিষয়েও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দলীয় পরিচয়ে যারা এখনো বীরদর্পে কাজ করছে তাদের বিষয়ে ইসি কিছুই করছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন বলেছিল, তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী জোটের কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না। অথচ প্রতিদিনই বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। নতুন নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর গত দুই সপ্তাহে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইসির নির্দেশনাকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ইসির নির্দেশ ছাড়াই যারা নির্বাচন পরিচালনায় কাজ করবেন তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। সব বিবেচনায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন আ’লীগেরই এজেন্ডা বাস্তাবায়ন করছে। সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে বলছে সেভাবেই তারা কাজ করছে। এদের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কখনোই সম্ভব হবে না। যেহেতু এরা সরকারের নির্দেশনার বাইরে কাজ করবে না তাই এই নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনভাবেই সামর্থ্য রাখে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সংবিধান জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন ছাড়া আর কোনো কমিশন এ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হয়নি। কারণ ক্ষমতায় থাকা দলীয় সরকারগুলোর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে পরিচালিত হয় ওইসব নির্বাচন। কমিশনের ভূমিকা ছিল নিতান্তই গৌণ। চলমান পরিস্থিতিতে বর্তমান কমিশনও আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

কেন এ প্রশ্ন, প্রথমে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে আসা যাক। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক বাম জোটসহ আরও কয়েকটি দল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দাবি জানালে তা আমলে না নিয়ে ২৩ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে কমিশন ৮ নবেম্বর তফসিল ঘোষণা করে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম জোট, ইসলামী আন্দোলন ও যুক্তফ্রন্ট ওই তফসিলে আপত্তি জানিয়ে তা পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। নির্বাচনী তফসিল এক মাস পিছিয়ে দেয়ার দাবির বিপরীতে কমিশন মাত্র এক সপ্তাহ পিছিয়ে ১২ নবেম্বর পুনরায় তফসিল ঘোষণা করে। পরে এক সপ্তাহ নির্বাচন পেছানো হয়। কমিশনের সচিব সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন না পেছানোর পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয় সেগুলো হচ্ছে- কোথাও পুনর্নির্বাচন ও উপনির্বাচন প্রয়োজন হলে জানুয়ারিতে তা সম্পন্ন করা, নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা, নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা এবং জানুয়ারির দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব ইজতেমায় লক্ষাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা। অনেকেই বলছেন, সরকারি দল আ’লীগের নির্দেশেই তারা নির্বাচন আর পেছানো থেকে বিরত ছিলেন। জনমনে যে ধারণাটি জন্মেছে তা হল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর ‘এক ঘণ্টার’ জন্যও নির্বাচন না পেছাতে চাপ সৃষ্টি করায় কমিশন নির্বাচন আর পেছাতে রাজি হয়নি। অতএব ‘নির্বাচনে কোনো দল বা দলীয় নির্দেশনার কাছে কমিশন মাথানত করবে না’- এ মর্মে সিইসি যে অঙ্গীকার করেছেন, তা কার্যত ভঙ্গ করা হয়েছে।
সংবিধান জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করলেও কমিশনের পক্ষে এ নির্বাচন পরিচালনা করে মূলত মাঠপ্রশাসন। আর নির্বাচন পরিচালনার মূল ক্ষমতা থাকে রিটার্নিং অফিসারের হাতে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতা ও দায়িত্বের বর্ণনা রয়েছে। ক্ষমতা ও দায়িত্বের মূল কথা হল- সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রিটার্নিং অফিসার আরপিও এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সবকিছু করবেন। সবকিছুর মধ্যে রয়েছে- প্রিসাইডিং অফিসার এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ, কমিশন নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠেয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক তার এলাকাধীন প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাছাই এবং যৌক্তিক কারণে কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল, বৈধ প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ, বৈধ প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ, তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীর ও অন্যান্য প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা উল্লেখপূর্বক গণবিজ্ঞপ্তি জারি এবং নির্ধারিত ফরমে কমিশনের কাছে সমম্বিত বিবরণী প্রেরণ। জানা গেছে, এইসব ক্ষেত্রে সবার মতামতকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে কমিশন দেশের ৬৪ জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় বিভাগীয় কমিশনারদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং সরকারের বিশ্বাসভাজন কর্মকর্তাদেরই এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

পৃথিবীর কোনো দেশে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। বাংলাদেশেও হবে না’ এবং ‘বড় পাবলিক নির্বাচনে যে অনিয়ম হবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না’- যথাক্রমে একজন নির্বাচন কমিশনার ও সিইসির এমন মন্তব্যে জনমনে ভোট নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না, তার ইঙ্গিত কমিশন জনগণকে আগেই দিয়ে রাখল। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনের সদিচ্ছা না থাকার মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া ‘পৃথিবীর কোনো দেশে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না’- এ বক্তব্য সত্য নয়। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এমন অনেক দেশ পৃথিবীতে আছে।
আচরণবিধি প্রয়োগে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা নেয়ার সময় মিছিল ও শোভাযাত্রা করে নির্বাচনী আচরণবিধি বড় দুই দলই ভঙ্গ করেছে। এতে ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখালেও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির ক্ষেত্রে কঠোর ছিল কমিশন। আচরণবিধি কার্যকরের নামে পুলিশি অ্যাকশনে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এই বিধি প্রয়োগে কমিশন শুরুতেই আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে কঠোর হলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। এতে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে কমিশন যে আগ্রহী নয়- এমন মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে।

এছাড়া নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির হাজারও নেতাকর্মী ‘গায়েবি ও হয়রানিমূলক’ মামলায় আটক রয়েছে। এদের বাইরে তফসিল ঘোষণার পরও দলটির শত শত নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশ থেকে আটক হওয়া নেতাকর্মীদের একটি তালিকা দলটি কমিশনে জমা দিলেও কমিশন এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণে বিরোধী দল বা গোষ্ঠীর হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আটক রেখে নির্বাচন করা হলে তা সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির নামে প্রহসন হবে মাত্র।
সূত্র মতে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারে ব্যানার, বিলবোর্ড, পোস্টারসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরিয়ে ফেলার সময় শেষ দিন ছিল গত ১৮ নবেম্বর। নির্দেশনা অনুযায়ী এগুলো না সরালে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা ইসির। ইসি সূত্র জানায়, আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, ভোটের নির্ধারিত তারিখের ২১ দিন আগে কোনো ধরনের প্রচার চালানো যাবে না। এ ছাড়া সব ধরনের প্রচারসামগ্রী হবে সাদাকালো। কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশে এখনো নৌকা প্রতীকের ব্যানার, পোস্টার আর বিলবোর্ডে ভরপুর। ইসির নির্দেশের পরও এগুলো সরানো হচ্ছেনা। এছাড়া সরকারি অফিসের সামনেও শোভা পাচ্ছে বড় বড় বিলবোর্ড। যেখানে নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া হয়েছে। অনেকেই বলছেন, সরকারি দলের আশীর্বাদ পুষ্ট হওয়ায় ইসি নৌকার প্রতীকের বিষয়ে কোনো প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না। এমনকি প্রশামনকেও এগুলো সরানোর নির্দেশ দিচ্ছে না। এছাড়া দেশের বিভিœœ স্থানে নৌকার পক্ষে প্রচারণা চলছেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ সেগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। ইসি তাদের ব্যাপাওে কোনো আইনগুত ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সূত্র মতে, নির্বাচন কমিশনে বারবার অভিযোগ সত্ত্বেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে একাধিক অভিযোগ করেছিল। কিন্তু সেগুলোরও কোনো ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যায়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রশাসনে রদবদল, নেতা-কর্মীদের হয়রানি বন্ধসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে আবারো নির্বাচন কমিশনে গিয়েছে বিএনপি। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নেতৃতে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে যান। জনপ্রশাসন ও পুলিশের দলবাজ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার, পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়া, গণমাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিজ্ঞাপন ও সরকারের উন্নয়নের প্রচার বন্ধ করার দাবি রয়েছে সেখানে।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, এখনও নৌকার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সব আয়োজন যেন করে রেখেছে সরকার ও প্রশাসন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে ইসির সুস্পষ্ট নির্দেশনা চায়। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য সমতল ক্রীড়াভূমি (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) সৃষ্টি করতে আমরা এর আগেও নির্বাচন কমিশনকে বলেছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, বিতর্কিত অর্ধশতাধিক সরকারি কর্মকর্তাকে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে আমরা ইসিকে অনুরোধ করেছি। আমাদের মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রতিদিন গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার নেতাকর্মীদের সুনির্দিষ্ট তালিকা আমরা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছি। সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষমতাসীনরা এমন আচরণ করছে, মনে হচ্ছে ভোট থেকে সরে যেতে বাধ্য করার জন্যই তারা তড়িঘড়ি করছে। আমরা অবিলম্বে সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সিইসির নির্দেশনা চেয়েছি, যাতে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকে। রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন ‘বঙ্গভবনে’ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী রাষ্ট্রপতি পুত্রের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সভা ও আপ্যায়ন অনুষ্ঠান হয়েছে অভিযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ব্রিফ করার বিষয়ে ইসিতে নালিশ দেয়ার পর এবার বঙ্গভবনের বিষয়ে অভিযোগ করল কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত এই জোট। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারদের ডেকে গত ১৬ নবেম্বর বৈঠক করেছেন। পরে ২০ নবেম্বর চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার, তার এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ডেকে কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব ঘটনা নির্বাচন আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়া চিঠিতে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীদের প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপির ঢালাও অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে না- ইসি সচিবের এম বক্তব্যের পর বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট আলাদা চিঠিতে নাম ধরে ধরে এই অভিযোগ দিল। তবে এ বিষয়ে কমিশনের কোনো বক্তব্য এখনও সাংবাদিকদের জানানো হয়নি।
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন জেএসডির সভাপতি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতা আ স ম আব্দুর রব। তিনি বলেন, আমরা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ড. কামালের নেতৃত্বে ইসি ও সরকারের বিরুদ্ধে এ মামলা করব। সংবিধানের কোথাও ইভিএম ব্যবহারের কথা উল্লেখ নেই। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ২(ক) তে বলা আছে, সংসদ গঠন হবে প্রত্যক্ষ ভোটে। ইভিএম প্রত্যক্ষ ভোটের আওতায় পড়ে না। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা সংবিধান বিরোধী। তাই সংবিধান সংশোধন ছাড়া ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না।
তিনি বলেন, ভোট দেয়া থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত সব নির্বাচনী প্রক্রিয়া জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকতে হবে। জনগণের কাছে এ মেশিনের স্বচ্ছতা নেই। নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে ইভিএম কেন্দ্রগুলোতে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। র্যা ব, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ডিবি, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলবো, আপনারা নিরপেক্ষ হন। নির্বাচনের পর দেশে আপনারা থাকবেন, আমরাও থাকবো। আপনাদের ভূমিকার জন্য জনগণের কাছে জবাব দিতে হবে।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারের চরম অনুগত নির্বাচন কমিশন দিয়ে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আরেকটি পাতানো নির্বাচনের পথে হাঁটছে নির্বাচন কমিশন। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার জন্য সবচেয়ে দায়ী নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন। রিজভী বলেন, প্রায় সাড়ে ৬ লাখ নির্বাচনী কর্মকর্তার অধিকাংশই আওয়ামী লীগের দলীয় লোকদের বাছাই করে তালিকা প্রস্তুত করছে পুলিশ। ইতিমধ্যে সারাদেশে ৪১ হাজার প্রিজাইডিং অফিসারের তালিকা পুলিশ প্রস্তুত করে ফেলেছে। এখন দুই লাখ সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও চার লাখ পোলিং অফিসারের তালিকাও প্রস্তুত করার দায়িত্ব পুলিশই পালন করছে। পুলিশের প্রস্তুত করা তালিকা শুধু চূড়ান্ত করার পথে তাবেদার নির্বাচন কমিশন। পুলিশ যে তালিকা প্রস্তুত করছে বা করেছে তার যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে আমাদের কাছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও অনলাইনে পুলিশ কর্তৃক নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত করার খবর বড় করে প্রকাশ হলেও নখ-দন্তহীন কমিশন রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। ক্ষেত্র বিশেষে অস্বীকারও করছে। দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জনগণের ভোটারাধিকার আবার হরণ করার জন্য নতুন চক্রান্তে মেতেছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন।

বিএনপির সিনিয়র এ নেতা বলেন, তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত বিরোধী দল দমনে সরকারের যে নিষ্ঠুরতা ছিল, তফসিল ঘোষণার পর সেটি আরও কঠোর আরও নির্মম রূপ লাভ করেছে। বিএনপি ও শরিক জোটকে দমনপীড়নে ব্যতিব্যস্ত রেখে সরকার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার আয়োজনাদি চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পূর্বে যেভাবে প্রশাসন সাজানো হয়েছিল তা সেইভাবেই অক্ষুণœ আছে। আওয়ামী লীগের দলবাজ কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এখন পর্যন্ত কোনো এসপি, ডিসি, ইউএনও বা ওসিকে বদলি করেনি নির্বাচন কমিশন। বরং তফসিল ঘোষণার পর বদলি বা পদায়নে কমিশনের মতামত লাগবে, অথচ এখনও সরকারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচন উপলক্ষে সরকারের সাজানো পুলিশ বাহিনীতে যাতে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা বদলি করা না হয়, সেজন্য গত সোমবার দুপুরে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সরকারের অনুগত একদল পুলিশ কর্মকর্তা বৈঠক করে এসেছেন।

সূত্র মতে, একদিকে চলছে ঢালাও গ্রেফতার অন্যদিকে সিইসি বলছেন অন্য কথা। গতকাল নির্বাচন কমিশনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেন, গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বিষয়ে পুলিশ ইসির অনুমতি ছাড়া কিছুই করবে না। পুলিশেকে নিরপরাধীকে কোনো ধরনের হয়রানি না করার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করার কথা আমরা বলিনি। এটি আপনারা করবেন না। কারণ এটি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। যারা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা তারা বিব্রত হন। আমরা এটি চাই না। তিনি বলেন, কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করবেন না। মামলা করবেন না। কাউকে হয়রানিমূলক মামলা বা গ্রেফতার করা যাবে না। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সিইসি আরও বলেন, যেন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখবেন।
বিশিষ্ট গবেষক অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসি যদি তা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে না পারেন, তবে তারা যেমন ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হবেন, তেমনি দেশও গভীর সংকটের মধ্যে পড়বে। এর পুরো দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তাবে। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনকে কালবিলম্ব না করে নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাকে দেয়া সাংবিধানিক ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্ব শর্ত প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকা। কিন্তু নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পূর্বে যেভাবে প্রশাসন সাজানো হয়েছিল তা সেইভাবেই অক্ষুণœ আছে। আওয়ামী লীগের দলবাজ কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এখন পর্যন্ত কোন এসপি, ডিসি, ইউএনও বা ওসিকে বদলি করেনি নির্বাচন কমিশন। বরং তফসিল ঘোষণার পর বদলি বা পদায়নে কমিশনের মতামত লাগবে, অথচ এখনও সরকারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপি বলছে, নির্বাচন উপলক্ষে সরকারের সাজানো পুলিশ বাহিনীতে যাতে কোন ধরনের পরিবর্তন বা বদলি করা না হয়, সেজন্য নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সরকারের অনুগত একদল পুলিশ কর্মকর্তা বৈঠক করে এসেছেন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসির ভূমিকায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না বিএনপি। বিএনপি বলছে, ইসি এখন পর্যন্ত একচোখা নীতিতেই চলছে। সাংবিধানিক এই সংস্থাটি তফসিল ঘোষণার পরেও নিরপেক্ষ ভূমিকায় যেতে পারছে না। তফসিল ঘোষণার পরেও সারাদেশে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমনকি জামিনে থাকা নেতাকর্মীদের পর্যন্ত গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিএনপি বলছে, তফসিল ঘোষণা হলেও সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি ইসি।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রশাসন ও পুলিশ নিয়ে বিএনপির ‘ঢালাও অভিযোগ’ আমলে নেয়া হবে না বলে মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তাই আমরা সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ জমা দিয়েছি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা সবসময় বলেছি যে, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। এটা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব যদি পালন করতে ব্যর্থ হয় তার জন্য জনগণের কাছে, জাতির কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আমরা আশা করি, আমরা বিশ্বাস করি যে, নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং জনগণের যে আশা-আকাক্সক্ষা, তা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনও সময় আছে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপ রুখে দিয়ে কমিশনের সাহসী ও সোজা হয়ে দাঁড়ানোর। আগামী সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, দেশের অধিকাংশ মানুষ এখন পর্যন্ত তা বিশ্বাস করে না। এ বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব মূলত কমিশনের। তাদের যেসব কর্মকা- মানুষের মনে এ বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে সেগুলো সংশোধন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচনে জনগণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় দলীয় সরকারগুলোর শাসনামলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়ে অতীতের কমিশনগুলো যেভাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, বর্তমান কমিশনের ভাগ্যেও তান্ডই ঘটবে।

http://www.dailysangram.com/post/354337