২১ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১২

কঠিন শর্তে বিশ্বব্যাংক থেকে ৬ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার

২০১৭ সালের ২১ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩০১ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের ১৫ নবেম্বর সেই রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১০১ কোটি ডলারে। অর্থাৎ গত দেড় বছরে রিজার্ভ কমেছে ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এদিকে জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো এবং ভ্যাট আইনের বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি কঠিন শর্তে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ৬ হাজার ২২৫ কোটি টাকা বাজেট সহায়তা ঋণ নিচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে পরবর্তী তিন অর্থবছরে সমান ২৫ কোটি ডলার করে মোট ৭৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা ঋণ দেবে। বর্তমান বিনিময়হার (৮৩ টাকা দরে) অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ৬ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। ৫ বছরের রেয়াতকালসহ ৩০ বছরে ২ শতাংশ সুদে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণ নিতে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের সমঝোতা চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরের এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে সরকার ৬০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা নিয়েছিল।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেসব শর্তে এই ঋণ নেয়া হচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা বলেন, বিশ্ব ব্যাংক সব দেশের জন্যই একসাথে নীতি-নির্ধারণী বিষয়গুলো গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে কোনো নীতি একটি দেশের জন্য প্রযোজ্য হলেও অন্য দেশের জন্য নাও হতে পারে। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের শর্তের মধ্যে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের শর্ত থাকলে তাহলে অবশ্যই এর দাম বৃদ্ধি পাবে। তখন আমাদের রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই বিশ্ব ব্যাংকের সকল শর্ত মানা উচিৎ নয়। দেশের অনেক বয়ঃজ্যেষ্ঠ বা অবসরপ্রাপ্ত মানুষ আছেন যারা সঞ্চয়পত্রের লাভের টাকায় চলেন। এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা করাও সরকারের উচিত হবে না।
ইআরডির এক কর্মকর্তা জানান, মোট তিন অর্থবছরের জন্য ৬ হাজার ২২৫ কোটি টাকা (৭৫ কোটি ডলার) বাজেট সাপোর্টের জন্য আমরা বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চুড়ান্ত করেছি। বিশ্ব ব্যাংক প্রতি অর্থবছরের জন্য ২৫ কোটি ডলার করে ছাড় করবে। এ সহায়তার জন্য বিশ্ব ব্যাংক যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলো নিজে থেকে বাস্তবায়ন করার কথা বলে আসছে সরকার। এসব শর্ত পালন করলে বরং দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। এই বাজেট সহায়তার বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরের সম্মতিও পাওয়া গেছে। তারা চূড়ান্ত অনুমোদন করার পর আগামী দুই মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হতে পারে।

বাজেট সহায়তা হিসেবে সরকার যে ঋণ নেয়, তা সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের সরকারি কোষাগারে জমা হয়। সেখান থেকে অগ্রাধিকার খাতে সরকারি এ অর্থ ব্যবহার করতে পারে।
বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বৈঠকের বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, বাজেট সহায়তার ঋণ পেতে সরকারকে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামের সমন্বয় করতে হবে। ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর-মূসক) আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়াও সঞ্চয়পত্রের বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির শর্ত দিয়েছে। পোশাক খাত ছাড়া অন্য সম্ভাবনাময় রফতানি খাতের জন্য বন্ডেড ওয়্যার হাউজ তৈরির শর্ত এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য এক ছাদের নিচে সব সেবা দেওয়ার শর্তও দিয়েছে। এছাড়া কর্মসংস্থান তৈরির জন্য প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ দ্রুত শেষ করা করার শর্তও দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
এদিকে গত দেড় বছরে রিজার্ভ কমেছে ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (২ বিলিয়ন ডলার বা ২০০ কোটি ডলার)। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধির গতি থেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২১ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩০১ কোটি (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন) ডলার। আর চলতি বছরের ১৫ নবেম্বর সেই রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১০১ কোটি (প্রায় ৩১ বিলিয়ন) ডলারে। সে হিসাবে বর্তমান বিনিময় হার (৮৩ টাকা দরে) দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

এতে আমদানির চাপ সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে সম্প্রতি এক ডজন ব্যাংককে শোকজ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই অপরাধে গত বছরের শেষ সময়ে ২৬ ব্যাংককে শোকজ করা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান কমে গেছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৪ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত কয়েক মাস ধরে আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) দেশে ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।

এদিকে গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরের শুরুতেও পণ্য বাণিজ্যে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই ও অগাস্ট মাসের বাণিজ্য ঘাটতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, এই সময়ে বাংলাদেশের পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর পুরো অর্থবছরে (জুলাই-জুন) বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ২৯৯ কোটি (প্রায় ২২ বিলিয়ন) ডলার। ওই বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০২ কোটি (প্রায় ২৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৬ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৩ কোটি (প্রায় ৩০ বিলিয়ন) ডলার। একইভাবে ২০১৭ সালের ২১ জুন রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০১ কোটি (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুনের পর থেকে রিজার্ভ আর বাড়েনি।

http://www.dailysangram.com/post/354249